মতামত

বইয়ের বাইরের পড়া

আমরা কেবল বই পড়েই জ্ঞানার্জন করি? না মনে হয়। বই পড়া বিশাল জ্ঞান কাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র অংশ। যে পড়তে জানে, সে পাখির গান পড়ে, ফুলের গন্ধ পড়ে, নদীর কলধ্বণি পড়ে, প্রকৃতি আর মানুষকে পড়ে। পড়ার কতো সংযোগ সূত্রই না জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। তা না-হলে, সক্রেটিস থেকে লালন পর্যন্ত লোকেরা কই পেলো এইসব জ্ঞান। আল-কোরানের প্রথম আয়াতেই বলা হচ্ছে, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে’। কিন্তু কী পড়বো? নির্দিষ্ট কোনো বই? স্কুল-কলেজের সিলেবাস ধরে পড়বো? নাকি পড়বো বই এবং বইয়ের বাইরের জগত?

আপাতভাবে এ সবই বড় আধ্যাত্মিক বা মরমী কথা মনে হয়। আমার মতো জাগতিক লোকের মুখে এসব বেমানান। অতএব জাগতিক কিছু পড়ার কথা বলি, যা না-পড়লে হয়তো বিপাকেই পড়তে হয়। অক্ষরজ্ঞান জানা লোক অনেক কিছুই আরোহণ করে বইয়ের বাইরে থেকে। মৌমাছি তো কেবল গোলাপ ফুল থেকেই মধু আরোহণ করে না।

এই যে পথে-ঘাটে বের হই, সবচেয়ে বেশি চোখে কি পড়ে? নাগরিক দেয়ালে, পিলারে, ফ্লাইওভারের খাম্বায় কিংবা যে কোনো ভবনে, বাজারে আমাদের সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে পোস্টার আর ব্যানার। সেগুলো অধিকাংশই রাজনৈতিক, তবে বিনোদন জগতের কথাও আছে। কোন সিনেমা কবে মুক্তি পাচ্ছে, কোন নেতার নিঃশর্ত মুক্তি চাই, কোন নেতা ফুলের মতো পবিত্র, কোন কোচিং সেন্টার দিচ্ছে বিসিএস থেকে এসএসসি পাশের মোক্ষম গ্যারান্টি- সেগুলো আমরা বই না-পড়েই জানতে পাই। অনেক সময় দৃষ্টি-দূষণের মতো মনে হলেও এইসব বিজ্ঞাপন, প্রচার, প্রসারের পোস্টারগুলো থেকেও চাইলে দৈনন্দিন জ্ঞান পাওয়া যায়। 

আমি তো সবচেয়ে জ্ঞানী হয়ে উঠি আমাদের সুপার শপগুলোতে গেলে। কতো রকমের কৌটা, বাক্স, প্যাকেট ভর্তি কতো জ্ঞান। কোনটা কোন দেশ থেকে এসেছে, কোনটার মধ্যে কী উপাদান আছে, কোনটার খাদ্য মূল্য কতোটুকু তার বিস্তৃত বর্ণনা দেয়া থাকেই এসব পণ্যের প্যাকেটে, বাক্সে বা কৌটায়। ব্রাজিলের কফি, দার্জিলিংয়ের চা, চায়নার নুডুলস, জাপানের খেলনা, আমেরিকার শ্যাম্পু, ইংল্যান্ডের সাবান, নিউজিল্যান্ডের দুধের প্যাকেটেও কম তথ্য থাকে না। এসব তথ্যের লেজ ধরে অনেকটা জ্ঞানের রাস্তায় হাঁটা যায় মুফতে, সুপারশপে। সুপারশপগুলো তাই জ্ঞান ভাণ্ডারও বটে।

ছোটবেলায় যখন বাসে করে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসতাম, তখন তো দোকানে দোকানে ঝোলানো সাইনবোর্ড থেকেই জানতে পারতাম, এখন ত্রিশাল আছি, এখন  ভালুকা। মাইল ফলকগুলো জানিয়ে দিতো ঢাকা কতো কিলোমিটার। এখন তো সড়কের এসব সাইনেজের আরো উন্নতি হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, জায়গায় জায়গায় বড় বড় মোড়ে বিশাল করে লেখা আছে, চিহ্ন দেয়া আছে কোন দিকে, কত দূরে বড় বড় কোন শহর। দেশের বাইরে গেলে বোঝা যায় রাস্তার সাইনেজ আর পথে পথে দোকানের লেখাগুলো কতোটা দিশা নেয়। 

কখনো-বা ভূগোল, ইতিহাসের হাল্কা পাঠ হয়ে যায় এইসব মাইলফলক, সড়ক ফলক, দোকানের সাইনবোর্ড অনুসরণ করলেও। কলকাতার অনেক কিছুই আমি চিনিছে, জেনেছি, পথে চলতে চলতে, হোক তা হলুদ টেক্সিতে বসে কিংবা পায়ে হেঁটেই। প্যারামাউন্টের শরবত কে কে খেতো, কে কে খেয়েছে, সে হিসাব তো দোকানের গায়েই লেখা আছে। আমাদের ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ের সামনেও রয়েছে এর ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদধূলির হিসাব। 

এখন কিন্তু বই না-পড়েও অনলাইনে চাইলেই জ্ঞান আরোহরণ করা যায়। আমার মতো যাদের চোখের সমস্যা আছে খানিক, দীর্ঘ পড়তে পড়তে চোখ ক্লান্ত তাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য অডিও-বুক। গত দুতিন বছরে আমি অডিও-বুক শোনার অভ্যাস রপ্ত করেছি। কানে একটা ভালো হেডফোন থাকলেই হাঁটতে হাঁটতে শোনা যায় বই। আমি বাসাবো মাঠে সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেকের হাঁটা সারি অডিও-বুক শুনতে শুনতে। ইউটিউবেও পাওয়া যায় নানা রকম জ্ঞানের ভাণ্ডার। টেড-টক তো এক কথায় দারুণ! আমি ইউটিউবে ‘ফিলোসফি ফর লাইফ’, ‘গ্রেট আর্ট এক্সপ্লেইন’, ‘দ্যা স্কুল অব লাইফ’ ইত্যাদি চ্যানেলের ভিডিও নিয়মিত দেখি। আর লার্নিং সাইট হিসেবে ‘কোরসেরা’, ‘উদমে’, ‘ডুওলিঙ্গো’, ‘লিঙ্কেডিন’ ইত্যাদি তো দারুণ! ‘গুড রিডস’, ‘পোয়েম হান্টার’, ‘কুয়ারা’, ‘ডিপস্ট্যাস’  ইত্যাদি লার্নিং অ্যাপ তো আমি মোবাইলে নিয়মিত ব্যবহার করি। অর্থাৎ বইয়ের বাইরে আমার পড়ালেখার জগতে এরা প্রতিদিনের সঙ্গী।  

অনেকেই ডিজিটাইল জগত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রাখেন। মোবাইল বা অনলাইন এডিকশন নিয়েও অনেক কথা আছে। আমার কথা হলো, যাহা বিষ, তাহাই ওষুধ এবং যাহা ওষুধ তাহাই বিষ। স্বাস্থ্যকর পালং শাকও তো আমরা প্রতিদিন খাই না, খেলেও পুরো পেট সেটা দিয়ে ভরি না। জ্বর হলে দুচারটা প্যারাসিটামল খাওয়া যায়, কিন্তু সেটা তো আর প্রতিদিনের ওষুধ না। তেমনি ভাবে, অনলাইনকে, মোবাইলকে কেউ যদি ব্যবহার করতে পারে, সে কিন্তু চাইলে জ্ঞান ভাণ্ডারের অনেক কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে বইয়ের পৃষ্ঠা না-খুলেই।

লেখাটা শেষ করি একটা কথা পরিষ্কার করে, জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সেই তাল-পাতার পূঁথি আর প্যাপিরাসের স্ক্রল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ডিভাইস পর্যন্ত, বই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। বই পড়তে হবে। বই পড়া আপনার জীবন-পাঠ এগিয়ে দেবে। কিন্তু এই লেখায় আমি বলার চেষ্টা করেছি, বইয়ের বাইরে আরো সব মাধ্যম থেকেও আপনি জ্ঞান নিতে পারেন। চোখ-কান-বোধ খোলা রাখলে শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় নয়, আরো অনেক জায়গাতেই জ্ঞান পেতে পারেন। পড়তে পারেন অনেক পড়া; বইয়ের বাইরেও। তবে বই বাদ দিয়ে নয়, বই সঙ্গে রেখেই বাড়ুক জ্ঞান চর্চার আরো মাধ্যমের সান্নিধ্য লাভ।