মতামত

অসুস্থ হয়ে পড়ছে সুন্দরবন, এমন খবর উদ্বেগের

দেশে দিবসের সংখ্যা কত? সঠিকভাবে বলা কষ্টকর। অনেক দিবস আছে যা সবার অজান্তেই আসে। পালিত হয়। ফের আসে। কেউ খবর রাখে না। খবর না রাখা দিবসগুলোর মধ্যে সবগুলোই যে অপ্রয়োজনীয় তা বলা যাবে না। অনেক প্রয়োজনীয় দিবস আছে যা ঘটা করে পালন না করায় নীরবে চলে যায়। একটু সচেতন হলেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় দিবসগুলো যথাযথ পালনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্য সফল করা যেতে পারে। প্রশ্ন আসে একটি দিবসের মধ্য দিয়েই কি সবটুকু সফলতা সম্ভব? মোটেই না। তবে দিন দিন মানুষকে সচেতন করে তোলা বা সম্মিলিতভাবে দিবস পালনের মধ্য দিয়ে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করা যায়। জাগরণ তৈরি করাও সম্ভব।  ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলাগুলোতে বেসরকারিভাবে সুন্দরবন দিবস পালন করা হচ্ছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো সুন্দরবন দিবস। নীরবে নিভৃতে চলে গেল গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসটি। যদিও সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারীভাবেই এই দিবসটি পালন করা উচিত। কেন এতোদিনে তা হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছেই এর জবাব হয়তো আছে। 

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক সুন্দরবন কি কোনো উপকারে আসছে না? এর জবাব সবচেয়ে বেশি দিতে পারবেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারপর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বন মন্ত্রণালয়। এরপর গবেষক থেকে শুরু করে পরিবেশ, প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা ও কত মানুষের জীবন জীবিকার উৎস এই বন তা বলে শেষ করা যাবে না। তেমনি পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় এই বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঘ, সিংহ থেকে এই বনে রয়েছে অনেক প্রজাতির প্রাণী। সিডর, আইলা থেকে শুরু করে কতোগুলো ভয়ঙ্কর রকমের ঝড় সুন্দরবন সবার আগে মাথা পেতে দিয়ে মোকাবিলা করেছে এর শেষ নেই। এতে বন ক্ষতিগ্রস্থ হলেও প্রাকৃতিক নিয়মে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

এর মধ্যে সবচেয়ে মন খারাপের খবর হলো, রোগবালাই বাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে। গাছ কাটা থেকে শুরু করে, জীববৈচিত্র ধ্বংসসহ নানামুখি অত্যাচারের খবরের ধারাবাহিকতা যখন চলমান তখন নতুন করে রোগবালাই বাড়ার খবরটি এল যা সত্যিই উদ্বেগের। প্রায় ৪০ শতাংশ সুন্দরী গাছ, ৫০ শতাংশ পশুর, ১০ শতাংশ গেওয়াসহ ৬ প্রজাতির গাছ এরই মধ্যে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলা হচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে। 

শুধু তাই নয়, মারাও যাচ্ছে অনেক গাছ। এ ছাড়া কমেছে সুন্দরী ও পশুর গাছের চারা গজানোর হার। এ রোগবালাইয়ের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন, উজান থেকে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। অর্থাৎ রোগ চিহ্নিত হয়েছে। সঠিক দাওয়াই দেয়া এখন সময়ের দাবি। 

৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে বনভূমি প্রায় ৭০ ভাগ; জলাভূমি ৩০ ভাগ। বনের ৬৪ শতাংশ গাছই সুন্দরী। এ ছাড়া গেওয়া ১৬ শতাংশ, পশুর ১ শতাংশ, বাইন ২ শতাংশ, গরান ৩ শতাংশ ও কেওড়া গাছ ১ শতাংশ। একাধিক গবেষণা বলছে, বনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী আগা মরা রোগ এবং ৫০ ভাগ পশুর হার্ট রট বা ঢোর রোগে আক্রান্ত। অধিক লবণাক্ত এলাকায় বয়স্ক সুন্দরী গাছ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অধিক ও মৃদু লবণাক্ত উভয় এলাকাতেই পশুর গাছ ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ঢোর রোগে আক্রান্ত গাছের বাকল ঠিক থাকে, তবে ভেতরের কাঠ পচে যায়। তার মানে দ্রুত গাছ মড়ে যেতে পারে। 

এখানেই কিন্তু শেষ নয়। আরো খাবার খবর আছে বনের ভেতরে। তা হলো- প্রায় ১০ ভাগ গেওয়া গাছের শেকড়ে পচন ধরেছে। বয়স্ক কিছু গেওয়া গাছেও আগা মরা রোগ দেখা দিয়েছে। অনেক বাইন গাছ হোলিং (গর্ত) রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত গাছে প্রথমে কাঠে পচন ধরে, এরপর সেই অংশে গর্ত হয়ে যায়। স্থানভেদে ১ থেকে ৫ শতাংশ বাইন গাছেও আগা মরা রোগ হচ্ছে। বনের কিছু কিছু গরান গাছে দেখা দিয়েছে ডাল পচন রোগ। আক্রান্ত গাছগুলো শুকিয়ে মারা যাচ্ছে।

শ্বাসমূলের ওপর পলি পড়ে অসংখ্য কেওড়া গাছ মারা যাচ্ছে। বনের কটকা এলাকার কেওড়া বন পুরো বিলীন হওয়ার পথে। কটকা বন অফিসের পেছন পাশে বিশাল এলাকায় গেলেও একই অবস্থা। আগে সেখানে হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল, এখন আর আগের মতো হরিণ দেখা যায় না।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২২ সালের নভেম্বরে 'ইকোলজিক্যাল মনিটরিং থ্রো এস্টাবলিশমেন্ট অব পার্মানেন্ট স্যাম্পল প্লটস ইন দ্য সুন্দরবন' শিরোনামে একটি গবেষণা করে। এতে বনের ৩৩টি স্থায়ী নমুনা প্লট থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সুন্দরী ও পশুর গাছের বীজ এবং চারার সংখ্যা দিন দিন কমছে। ওই বছর প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩৮ হাজার ৭৯২টি চারা হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরী গাছের চারা ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। সংস্থাটির ২০০৯ সালের গবেষণার তথ্য বলছে, ওই বছর সুন্দরী গাছের চারা গজানোর হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

গবেষকরা জানান, আগা মরা সুন্দরী গাছে এমনিতেই বীজ কম হয়, যা হয় তার থেকে অঙ্কুরিত হয় আরও কম। ওই চারার টিকে থাকার হারও কম। এতে ক্রমান্বয়ে কমছে সুন্দরী গাছের চারার পরিমাণ। ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় বনের মধ্যে লবণাক্ত পানির চাপ বেড়েছে। সেইসঙ্গে উজান থেকে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। এতে বনের মাটি ও পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। এর প্রভাবে বনের গাছপালার রোগবালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গাছের রোগের কারণ, অবস্থা এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। 

তাছাড়া যে গাছের নামানুসারে বনের নাম সেই সুন্দরী গাছ রোগের কারণে কমে যাচ্ছে, বিষয়টি উদ্বেগের। অর্থাৎ সুন্দরী ও পশুর গাছের সংখ্যা যদি কমে যায় তাহলে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ঠিক থাকবে না। আবার বেশি লবণসহিষ্ণু গাছের চারা গজানোর হার বেড়ে গেছে। এ অবস্থা নিরসনে উজান থেকে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশের উপকূলকে রক্ষা করতে হলে সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। তেমনি সুন্দরবন ঘিরে মানুষের জীবন জীবিকা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে গোটা অর্থনীতিতে বড় রকমের ধাক্কা আসবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করে গাছের রোগ নির্নয় ও প্রতিকারে কাজ শুরু জরুরি। তেমনি ভারতের অংশের পরিস্থিতি জেনে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবন ভালো না থাকার খবর স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। উদ্বেগের সঙ্গে বিষয়টি নজরে নিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না-নিলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। আশাকরি, কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করবেন।    

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক