মতামত

‘জুলাই দাঙ্গা’, বিপ্লব নাকি গণঅভ্যুত্থান?

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটিকে ‘জুলাই দাঙ্গা’ এবং একটি ‘ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিপরীতে, কেউ কেউ একে ‘জুলাই বিপ্লব’ বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আলোকে প্রশ্নটি হলো—এটি কি আসলেই জুলাই দাঙ্গা, বিপ্লব নাকি গণঅভ্যুত্থান? সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বগত আলোচনা এই আন্দোলনের রূপগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ জরুরি।

এই আন্দোলকে ‘জুলাই দাঙ্গা’ ‘জুলাই সন্ত্রাস’ কিংবা ‘ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার একটি অবমাননাকর প্রয়াস ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শব্দ চয়ন। কারণ দাঙ্গা সাধারণত সহিংস, বিভ্রান্তিকর ও অপরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা বোঝায়, যেখানে জনগণের যৌক্তিক রাজনৈতিক দাবির গুরুত্ব থাকে না। ‘জুলাই দাঙ্গা’ বলা মানে আন্দোলনের ন্যায্যতাকে অস্বীকার করা এবং জনগণের সংগ্রামকে অপরাধীকরণ করা। এটি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারীদের বয়ান, যার উদ্দেশ্য আন্দোলনকারীদের নিন্দা করে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নকে বৈধতা দেওয়া।

২০২৪ সালের জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নাটকীয় বাঁকবদলের চিহ্ন রেখে যায়। ছাত্র-জনতা, চাকরিপ্রার্থীরা, নাগরিক সমাজ রাস্তায় নামে। তারা রাষ্ট্রীয় দমন, বৈষম্য, কোটানীতি, দুর্নীতি, বিচারহীনতা ও শাসনব্যবস্থার অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়। এই আন্দোলনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে পরিচিত হতে শুরু করে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহল এই ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আখ্যায়িত করে; শব্দ চয়নের এই রাজনীতি শুধু সত্য আড়াল করতেই নয়, বরং জনতার ন্যায্য প্রতিবাদকে অপরাধী ও অবৈধ প্রমাণ করার একটি রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। 

সন্ত্রাস বলতে বোঝায় পরিকল্পিতভাবে নিরীহ জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য সহিংসতা চালানো, যা সাধারণত রাজনৈতিক বা আদর্শিক লক্ষ্যসাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জুলাই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য কোটানীতির সংস্কার, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ, মেধার মূল্যায়ন, এবং বিচারহীনতার অবসান। কোথাও দেখা যায়নি আন্দোলনকারীরা পরিকল্পিতভাবে জনসাধারণের ওপর আক্রমণ করেছে বা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বরং তারা ছিল নিরাপত্তাবাহিনীর গুলির শিকার। অতএব, এটি কোনোভাবেই সন্ত্রাসের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। বরং সন্ত্রাস হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে—গণগ্রেপ্তার, গুম, গুলি করে হত্যা এবং তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।

দাঙ্গা সাধারণত ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অথবা গোষ্ঠীগত বিরোধ থেকে উৎসারিত সহিংসতা যা অনিয়ন্ত্রিত ও ধ্বংসাত্মক হয়। ‘জুলাই দাঙ্গা’ বলা মানে হচ্ছে আন্দোলনের সংগঠিত নৈতিক চরিত্রকে অস্বীকার করা। জুলাইয়ের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, চাকরিপ্রার্থী যুবক, চিকিৎসক, শিক্ষক এমনকি অভিভাবকরা। এটা ছিল ব্যাপক জনপ্রতিনিধিত্বের একটি সচেতন আন্দোলন। 

‘জুলাই সন্ত্রাস’ বা ‘জুলাই দাঙ্গা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ একদিকে নিজস্ব দমননীতিকে বৈধতা দিতে চায়, অন্যদিকে আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। এটি একটি ক্লাসিক ‘narrative warfare’ যেখানে ভাষাকে অস্ত্র বানিয়ে জনগণের যৌক্তিক প্রতিরোধকে ‘অপরাধ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ‘A riot is a public disturbance involving an act or acts of violence by one or more persons in an assembly of three or more people, which creates a clear and present danger of damage or injury to property or persons.’ — United States Federal Law, 18 U.S. Code § 2102

‘দাঙ্গা হলো একটি জনসমাবেশে (তিন বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশে) একজন বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত সহিংস কার্যকলাপ, যা মানুষ বা সম্পত্তির ক্ষতি বা আঘাতের স্পষ্ট ও তাৎক্ষণিক ঝুঁকি সৃষ্টি করে।’

বাংলাদেশে দণ্ডবিধি আইনের ১৪৬ ধারা অনুযায়ী ‘যদি পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি বেআইনি জমায়েত (unlawful assembly)-এর সদস্য থাকে এবং সেই জমায়েতে জড়িত কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বেআইনি বল প্রয়োগ বা বেআইনি বল প্রয়োগের হুমকি দেয়, তাহা হইলে উক্ত জমায়েতটি দাঙ্গায় পরিণত হয়।’ ধারা ১৪৮ অনুযায়ী দাঙ্গায় বিপজ্জনক অস্ত্রসহ অংশগ্রহণকারীদের উপস্থিতি থাকে। যখন একটি গণআন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ বলা হয়, তখন সেটি আর গণতান্ত্রিক অধিকার বলে বিবেচিত হয় না; বরং তা হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। এর মাধ্যমে সরকার জনগণের ক্ষোভের ন্যায্য কারণকে অস্বীকার করে সেটিকে নৈতিক ও আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্য দেখাতে চায়।

‘সন্ত্রাস’ বা ‘দাঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় দমননীতিকে বৈধতা দেওয়া যায়। যার মাধ্যমে গণগ্রেপ্তার, গুলি চালানো, ইন্টারনেট বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধসহ দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। সরকার তখন এসব কর্মকাণ্ডকে ‘রাষ্ট্র রক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ হিসেবে বৈধতা দিতে পারে। এভাবেই আওয়ামী লীগ তার দমননীতিকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।

রাজনৈতিক ভাষা শুধু প্রতিপক্ষকে দমন করতেই ব্যবহৃত হয় না, বরং জনগণের মনে ভয় এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যও ব্যবহার করা হয়। ‘সন্ত্রাস’ শব্দ শুনলে সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়, আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। সরকারের উদ্দেশ্য হলো—এই শব্দ ব্যবহার করে জনসম্পৃক্ততা নষ্ট করা, আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি কমানো এবং ভবিষ্যতের গণআন্দোলনের সম্ভাবনাও দুর্বল করে দেওয়া।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ‘দাঙ্গা’ বা ‘সন্ত্রাস’ বলার পেছনে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো আন্দোলনের নৈতিকতা ধ্বংস, রাষ্ট্রীয় দমননীতি বৈধ করা, জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং ভবিষ্যতের প্রতিরোধ প্রতিরোধ করা। এটি একটি রাজনৈতিক ভাষার যুদ্ধ, যেখানে শব্দের মাধ্যমে ইতিহাস ও বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে।

২০২৪-এর এই আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মুহূর্ত, যেখানে জনতার ন্যায্য দাবির প্রকাশ ঘটে শান্তিপূর্ণ ও সংগঠিতভাবে। এটিকে ‘সন্ত্রাস’ বা ‘দাঙ্গা’ বলার চেষ্টা মূলত সত্য ধামাচাপা দেওয়ার ভাষাগত ষড়যন্ত্র। ইতিহাস এই বিকৃতি মেনে নেবে না। বরং সময় প্রমাণ করবে— জুলাই ছিল জনতার জাগরণ, দাঙ্গা বা সন্ত্রাস নয়।

বিপ্লব হচ্ছে একটি মৌলিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর। এটি সাধারণত বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতা, শাসন কাঠামো বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুন এক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী থিওডর স্ককপল, ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী জন ডান এবং জার্মান বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতি বিশ্লেষক হান্না অ্যারেন্ট-এর মতো চিন্তাবিদদের মতে, বিপ্লব তখনই ঘটে যখন শাসকের প্রতি জনগণের আনুগত্য ভেঙে পড়ে, আর বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থান পূরণে সক্ষম হয়। সফল বিপ্লবের মূল উপাদান হলো: শাসন কাঠামোর পতন ও নতুন কাঠামোর উদ্ভব, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা বা ভেঙে পড়া, আদর্শগত নেতৃত্বের উপস্থিতি, দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত পরিবর্তন।

মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানী থিওডর স্ককপল (Theda Skocpol)  বিপ্লবের সংজ্ঞায় বলছেন: ‘Social revolutions are rapid, basic transformations of a society’s state and class structures; and they are accompanied and in part carried through by class-based revolts from below’ অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লব হলো রাষ্ট্র ও শ্রেণিকাঠামোর দ্রুত ও মৌলিক রূপান্তর; যা নিম্নবর্গীয় শ্রেণিভিত্তিক বিদ্রোহ দ্বারা সংঘটিত ও আংশিকভাবে পরিচালিত হয়।  Skocpol, Theda. States and Social Revolutions: A Comparative Analysis of France, Russia, and China. Cambridge University Press, 1979. page: 4

থিওডর স্ককপল-এর মতে বিপ্লব হলে রাষ্টযন্ত্রের কাঠামোগত ভাঙন হয়, সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ বিদ্রোহ করে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক রূপান্তর ঘটে। তার মতে বিপ্লব ‘ইচ্ছা দিয়ে তৈরি হয় না’, বরং ‘সামাজিক কাঠামোর সংকট ও ভাঙনের ফল হিসেবে ঘটে।’ ব্রিটিশ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ জন ডান (John Dunn) বিপ্লব বিষয়ক চিন্তায় নৈতিকতা, রাজনৈতিক দায়িত্ব ও ইচ্ছাশক্তির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বিপ্লবকে একটি রাজনৈতিক কর্মধারা হিসেবে বোঝার ওপর গুরুত্ব দেন—বিশ্লেষণ করেন কোন পরিস্থিতিতে মানুষ বিপ্লব ঘটাতে চায়, এবং তারা কিভাবে তা ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে।

জন ডান-এর বিপ্লবের সংজ্ঞা: “A revolution is a deliberate political act, in which people try to take control of their political circumstances by force, often seeking legitimacy in doing so.” — John Dunn, “Modern Revolutions: An Introduction to the Analysis of a Political Phenomenon,” 1972, p. 4 অর্থাৎ বিপ্লব হলো একটি সচেতন রাজনৈতিক কর্ম, যেখানে মানুষ জোরপূর্বক তাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে এবং প্রায়শই সেই কর্মকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বৈধতার যুক্তি খোঁজে।

স্ককপলের বিপরীতে জন ডান মনে করেন, বিপ্লব মূলত মানুষের সচেতন রাজনৈতিক ইচ্ছার ফল। জন ডান বিপ্লবকে নৈতিক সিদ্ধান্ত ও বৈধতা অর্জনের চেষ্টা হিসেবে দেখেন। জন ডানের মতে বিপ্লব হলো নিচ থেকে উপরের দিকে ক্ষমতা কাড়ার প্রয়াস যেখানে জনগণ নিজেরাই শাসনব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব দাবি করে।

জার্মান বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী হান্না অ্যারেন্ট (Hannah Arendt) বিপ্লব চিন্তায় একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এনেছেন। তিনি বিপ্লবকে কেবলমাত্র সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে দেখেন না বরং ‘নতুন রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা’ হিসেবে দেখেন। তিনি বিপ্লবের সংজ্ঞায় বলেছেন, “The meaning of revolution is the attempt to found a new body politic, to bring freedom into the world.” — Arendt, On Revolution, 1963, p. 21 হান্না অ্যারেন্টের মতে “বিপ্লবের অর্থ হলো নতুন এক রাজনৈতিক গঠনতন্ত্র গড়ে তোলার প্রয়াস—পৃথিবীতে স্বাধীনতাকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা।”

কার্ল মার্কস বিপ্লবের সংজ্ঞা কীভাবে দিয়েছেন তা বোঝার জন্য মূলত তাঁর রচনাগুলো থেকে ধারণা নিতে হয়, যেমন: ‘The Communist Manifesto’, ‘Critique of Hegel's Philosophy of Right’, ‘The Class Struggles in France’ ইত্যাদি। তাঁর রচনার ভিত্তিতে আমরা একটি নির্যাসমূলক সংজ্ঞা তৈরি করতে পারি:কার্ল মার্কসের দৃষ্টিতে বিপ্লবের মূলভাব হলো: “A revolution is the forcible overthrow of the existing social and economic order by the proletariat to establish a classless society.” অর্থাৎ  ‘বিপ্লব হলো বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ, যা প্রলেতারিয়েত শ্রেণি কর্তৃক একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়।’ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বিপ্লবকে একটি ঐতিহাসিক ও শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন, যা শাসক শ্রেণির রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে ভেঙে দিয়ে শোষিত শ্রেণির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। লেনিন স্পষ্টভাবে বিপ্লবের সংগঠক, শর্ত, এবং লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেছেন। লেনিনের অভিমতে বিপ্লব হলো: “A revolution is impossible without a revolutionary crisis; furthermore, not every revolutionary crisis leads to revolution.” — Lenin, The Collapse of the Second International (1915)

বিপ্লব হলো এমন একটি রাজনৈতিক উলট-পালট, যেখানে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধ্বংস করে শ্রমজীবী জনগণের নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা হয়। বিপ্লব ঘটে তখনই, যখন শাসক শ্রেণি আর আগের মতো শাসন করতে পারে না, আর শোষিত শ্রেণি আর আগের মতো সহ্য করতে চায় না। লেনিনের কাছে বিপ্লব ছিল একটি জাগ্রত ও সক্রিয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা একটি পুরাতন শোষণভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটি কেবল একটি ঘটনা নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক গতি, যা সচেতন শ্রেণিসংগ্রামের ফসল।

২০২৪-এর আন্দোলনের কিছুদিন পর থেকেই বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার কর্মী এবং বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিরা একে ‘জুলাই বিপ্লব’ বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। প্রশ্ন হচ্ছে—এই আখ্যার নেপথ্যে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? রাজনৈতিক ভাষার শক্তি অনেক। কেউ যদি একটি আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে তারা সেই ঘটনার উপর নৈতিক ও আদর্শিক কর্তৃত্ব দাবি করতে পারে। ‘বিপ্লব’ শব্দটি শোনামাত্রই মানুষের মনে একটি গৌরবময়, রূপান্তরমূলক এবং ন্যায়ের প্রতীকী ধারণা তৈরি হয়। তাই জুলাই অভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ বলার মাধ্যমে কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী এটিকে ইতিহাসে একটি বিজয়ী ও গৌরবময় চেতনার অংশ বানাতে চায়। 

বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি রাজনৈতিক দলের দখলে—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ২০২৪ সালের আন্দোলনে রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রকাশ্যে সাংগঠনিকভাবে প্রধান ভূমিকা রাখেনি। এটি ছিল মূলত ছাত্র-যুব, চাকরিপ্রার্থী এবং নাগরিক সমাজের হাত ধরে গড়ে ওঠা এক আন্দোলন। যারা এই আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’ বলছে, তারা চায় এই ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলনকে ভিত্তি করে একটি নতুন রাজনৈতিক বলয়ের জন্ম দিতে।

‘বিপ্লব’ শব্দ ব্যবহার করে আন্দোলনকারীরা সরকারবিরোধী অবস্থানকে কেবল রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, বরং নৈতিক ও আদর্শিক সংগ্রাম হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। এই আখ্যা সরকারকে একটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি’ এবং নিজেদেরকে ‘জনগণের প্রতিনিধি’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা। যারা আজ ‘জুলাই বিপ্লব’ বলছে, তারা চাইছে ইতিহাসে নিজেদের ‘বিপ্লবী উত্তরাধিকার’ প্রতিষ্ঠা করতে যা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও জনসমর্থনের উৎস হতে পারে। ‘জুলাই বিপ্লব’ বলা নিছক আবেগ বা প্রচারণা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল যার মাধ্যমে আন্দোলনের বয়ান নিয়ন্ত্রণ, বিকল্প আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব অর্জনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ইতিহাস একমাত্র ভাষার ওপর নির্ভর করে না; সময়, কাঠামোগত রূপান্তর, এবং জনগণের প্রত্যক্ষ জীবনমানের পরিবর্তনই নির্ধারণ করবে এটি আদৌ বিপ্লব কি না।

অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান (Mass Uprising)  একটি বৃহৎ জনতার হঠাৎ বিস্ফোরিত প্রতিক্রিয়া, যা কিছু সময়ের জন্য রাজনৈতিক চাপে পরিণত হয়, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র কাঠামো বা শাসনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন নাও ঘটতে পারে। গণঅভ্যুত্থান সাধারণত:কোনো তাৎক্ষণিক অন্যায় বা নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া, রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে অস্পষ্ট, দমননীতি ও সামরিক হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নবজাগরণ দিয়ে। তবে এটি খুব দ্রুত রূপ নেয় ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভে, যা পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক একনায়কত্ব, এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি গণচেতনায় রূপ নেয়। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল: বৃহৎ জনগণের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষতা, প্রযুক্তিনির্ভর সংগঠিতকরণ। এই গণঅভ্যুত্থান দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি, গ্রেপ্তার, নিখোঁজের ঘটনা, এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়।  “A mass uprising is a large-scale, often spontaneous and loosely organized protest movement involving diverse social groups, aimed at expressing discontent and pressuring the state or ruling elite without necessarily intending to overthrow the entire regime.” — Charles Tilly, “From Mobilization to Revolution,” 1978

 “গণঅভ্যুত্থান হলো বৃহৎ পরিসরের, প্রায়শঃই স্বতঃস্ফূর্ত ও শিথিলভাবে সংগঠিত একটি বিক্ষোভ আন্দোলন, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণ অংশ নেয় রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, তবে এটি সর্বদা সরকারের পতনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় না।” “A mass uprising involves collective action by a significant portion of the population in opposition to state authority, often triggered by grievances related to economic hardship, political exclusion, or repression.” — Jack Goldstone, “Revolutions: A Very Short Introduction,” Oxford University Press, 2014

“গণঅভ্যুত্থান হলো জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সংঘবদ্ধ কার্যক্রম, যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধিতায় পরিচালিত হয় এবং সাধারণত অর্থনৈতিক কষ্ট, রাজনৈতিক বঞ্চনা বা দমন-পীড়নের মতো ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত হয়।”

এখন আমরা বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের তুলনামূলক আলোচনা করতে পারি। বিপ্লব বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা ভেঙে নতুন শাসন ও সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতির প্রতিবাদ; চাপ প্রয়োগ বা সংস্কারের দাবি জানায়। বিপ্লবে সুসংগঠিত নেতৃত্ব ও আদর্শিক ভিত্তি থাকে (যেমন: মার্ক্সবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি)। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান অনেক সময় নেতৃত্বহীন বা দুর্বলভাবে সংগঠিত; তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয়। বিপ্লবের ফলে শাসনব্যবস্থার পতন ও নতুন কাঠামোর সূচনা হয় (যেমন নতুন সংবিধান, অর্থনৈতিক কাঠামো)। বিপ্লব দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া যা বছরজুড়ে চলতে পারে, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান সাধারণত স্বল্পমেয়াদি, হঠাৎ বিস্ফোরণ। বিপ্লবের ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বিধাগ্রস্ত বা আন্দোলনের পক্ষে চলে যেতে পারে, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণত কঠোরভাবে দমন করে; রাষ্ট্রীয় দমন প্রবণতা বেশি। বিপ্লবে নির্বাচিত শ্রেণি বা দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানে নানান শ্রেণি-পেশার জনতা অংশ নেয়, অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

২০২৪ সালের এই আন্দোলন বিপ্লব নয়; যদিও ‘জুলাই আন্দোলন’ ছিল ব্যাপক, তা সত্ত্বেও এটি বিপ্লব নয়। কারণ ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, শুধু সরকারের পতন হয়েছে, সংবিধান পাল্টায়নি, রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়েনি কিংবা আমূল পরিবর্তন হয়নি। এই আন্দোলনে ছিল ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশ। যেখানে রাজনৈতিক আদর্শিক চেতনা প্রকট ছিল না। স্বল্পকালীন রাজনৈতিক আলোচনার পর সরকার ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ ঘোষণা করলেও মূলত পুরোনো কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। 

তাহলে কী ছিল ‘জুলাই’? তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে একে গণঅভ্যুত্থান বলাই অধিক যৌক্তিক। কারণ এটি ছিল জনগণের আত্মপ্রকাশ ও বিরোধিতার সর্বোচ্চ প্রকাশ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী বিস্ফোরণ, শাসকদের গণতন্ত্রবিরোধী চরিত্র উন্মোচনের মোক্ষম মুহূর্ত, দীর্ঘদিন জমে থাকা অসন্তোষের মুখ ফাটানো প্রতিবাদ। তবে এটিকে একটি অসমাপ্ত প্রক্রিয়া বলাও চলে— এই আন্দোলন বিপ্লবের সূচনাপর্ব বলা যেতে পারে। যেখানে জাতি আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নেতৃত্ব খুঁজছে।

‘জুলাই দাঙ্গা’, ‘জুলাই বিপ্লব’ নাকি ‘গণঅভ্যুত্থান’—এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আমরা ঘটনাটিকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি? রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রযন্ত্র এটিকে ‘দাঙ্গা’ বলবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। বিপ্লবী রোমান্টিকরা একে ‘বিপ্লব’ বলতে চাইবে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে। কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, এটি একটি সচেতন, স্পষ্ট, তীব্র গণঅভ্যুত্থান, যার ভিতরে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক রূপান্তরের বীজ নিহিত আছে। এই অভ্যুত্থান হয়তো তাৎক্ষণিক কাঠামো ভাঙতে পারেনি, কিন্তু মানুষের সচেতনতা, জবাবদিহির দাবি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিয়েছে যা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অনিবার্য। 

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক