বগুড়ার ধুনট উপজেলার প্রথম আলোর সাংবাদিককে মারধর করলেন আওয়ামী লীগের নেতারা— সংবাদটি ১৮ ডিসেম্বরের। তবে ২০২৫ সালের নয়, এটি ২০০৯ সালের। আওয়ামী লীগ তখন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করেছে।
কি নির্মম পরিণতি! ২০২৫ সালে এসে আরও ভয়াবহভাবে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সরকার শুধু এর দায় নেবেন, নাকি দোষের ভাগটাও নেবেন? প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদীচীতে হামলা পূর্ব নির্ধারিত। সরকার এই হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। কেনো হাদির খুনি এখনো স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বেড়াচ্ছে, কেন আগুনসন্ত্রাসীরা এখনও নিশ্চিন্ত? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের কাছে না থাকলে কার কাছে থাকবে? হাদির খুনিদের বের করতে না পারার ব্যর্থতায় সরকারের প্রতি জনমনে যে ক্ষোভানল তৈরি হয়েছে তা সরকারের অজানা নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও ঠিক একই কারণে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার ঘটনা ছাড়াও প্রতীকীভাবে যদি ২০০৯ থেকে পরবর্তী ১৬ বছরের প্রতিটি ১৮ ডিসেম্বরকে পাশাপাশি রাখা হয়, দেখা যাবে—প্রথম আলো ধারাবাহিকভাবে সরকারের নীতিগত অসঙ্গতি, প্রশাসনিক অনিয়ম এবং সংবেদনশীল বিষয়গুলো সংবাদে তুলে এনেছে। রাজনৈতিক অস্বস্তির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত ছিল, এবং বছরের অধিকাংশ দিনই এ ধরনের প্রতিবেদন তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম আলো শুধু সংবাদপত্রই নয়, বরং সংবাদপত্রের চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করেছে।
প্রথম আলোর এই অবস্থানের ফলে বিভিন্ন সময়ে সরকারি দপ্তরে প্রবেশাধিকার সীমিত হয়েছে, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চাপ তৈরি হয়েছে, এবং মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকরা নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। তবু এসব পরিস্থিতির মধ্যেও প্রথম আলো নিয়মিত প্রকাশনা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদ উপস্থাপনা বা শব্দচয়নে ভুলও ঘটেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, সংবেদনশীল ও বিতর্কিত ঘটনাগুলোতে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।
আমরা সবাই জানি, আগুনের নিজস্ব কোনো মতাদর্শ নেই, তবু ইতিহাসে আগুন বারবার একটি ভাষায় কথা বলেছে— তা হলো ভয় দেখানোর ভাষা। যখন কোনো সমাজে সংবাদপত্রের অফিসে আগুন জ্বলে, তখন তা কেবল কাঠ-ইট-যন্ত্রপাতির ধ্বংস নয়; এটি বরং বিবেচিত হয় মত প্রকাশের স্বাধীনতার লাল সংকেত হিসেবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, এই সংকেত শুধু আমাদের দেশ বা আমাদের প্রজন্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানবাধিকার চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার পূর্বমূহুর্তে পৃথিবীর অনেক দেশে এর উদাহরণ আছে। গত সরকারের আমলে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে, তার থেকেও আমারা শিক্ষা নিইনি। কিন্তু অগুনসন্ত্রাসীদের বোঝা উচিত ইতিহাসে যারাই এই কাজ করেছে, তারাই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
১৯৩৩ সাল, হিটলার ক্ষমতায়। এক সকালে সমাজতান্ত্রিক দৈনিক Vorwärts এর অফিসের সামনে ব্রাউনশার্ট বাহিনী জড়ো হয়। জানালার কাঁচ ভাঙা হলো, ছাপাখানার যন্ত্র উল্টে দেওয়া হলো, কাগজে আগুন ধরানো হলো। কোনো আদালতের রায় নয়, কোনো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা নয়, তবু পত্রিকাটি কার্যক্রমে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনা একক ছিল না; ইহুদি মালিকানাধীন, উদারপন্থী বা বামপন্থী পত্রিকাগুলো একে একে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তি কেন সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে আগুন বা ভাঙচুরের পথ বেছে নেয়? সাধারণত এর তিনটি কারণ দেখা যায়। প্রথম কারণ, দায় অস্বীকারের সুযোগ: আগুন লাগালে বলা যায়, এটি জনরোষ, রাষ্ট্র জড়িত নয়। দ্বিতীয় কারণ, ভয়ের স্থায়ী প্রভাব: আইন বদলানো যায়, আদেশ প্রত্যাহার হয়, কিন্তু আগুনের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী। তৃতীয় কারণ, সেলফ সেন্সরশিপ বা আত্মনিয়ন্ত্রণ: একটি অফিস পুড়লেই বাকিরা শিখে যায়—কোথায় থামতে হবে।
এই অবস্থায় গণমাধ্যম আর রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ থাকে না; হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের বারান্দা। কাগজ ছাপা হয়, শিরোনাম আসে, কিন্তু সেই শিরোনামে থাকে না ক্ষমতার প্রতি প্রশ্ন, থাকে না নৈতিক অস্বস্তি। ইতিহাস বলছে, এই পর্যায়ে পৌঁছানোর পর আর আগুনের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ভয় তখন অভ্যন্তরীণ হয়ে যায়—সাংবাদিকের কলমে, সম্পাদকের ডেস্কে, প্রকাশকের সিদ্ধান্তে।
এই প্যাটার্ন সীমিত নয়। মুসোলিনির ইতালিতে ফ্যাসিস্ট স্কোয়াডগুলো বিরোধী পত্রিকার অফিসে ঢুকে ছাপাখানা ধ্বংস করত। পিনোচের চিলিতে সাংবাদিকেরা নিখোঁজ হতেন, অফিসগুলো সিলগালা হতো। আর্জেন্টিনা, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া—প্রতিটি জায়গায় একই দৃশ্য, ভিন্ন মুখ। প্রথমে বলা হয়, ‘এই মিডিয়া পক্ষপাতদুষ্ট’ তারপর ‘এরা রাষ্ট্রের শত্রু’ শেষে ‘জনতা রেগে গেছে’ এবং আগুন জ্বলে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে এই ঐতিহাসিক ধারার মিল চোখে পড়ে। গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা, সহিংসতাকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং দোষীদের দ্রুত বিচারের অনুপস্থিতি—এই তিনটি উপাদান একসঙ্গে উপস্থিত হলে গণতন্ত্র দুর্বল হতে শুরু করে, ধীরে, নীরবে।
নাৎসি জার্মানিতে একসময় আর পত্রিকা পোড়ানো হয়নি। কারণ পোড়ানোর মতো স্বাধীন পত্রিকাই ছিল না। কাগজ বের হতো, কিন্তু প্রশ্ন বের হতো না। এই পরিণতি হঠাৎ আসেনি; এসেছে একের পর এক ছোট ঘটনায়—একটি অফিসে আগুন, একটি পত্রিকা বন্ধ, একটি সম্পাদক গ্রেপ্তার।ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এখানেই—গণমাধ্যম দমন কখনো একদিনে পূর্ণতা পায় না।
এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকাও একরৈখিক নয়। গণমাধ্যমও ভুল করেছে, কখনো পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে, কখনো আত্মসমালোচনার অভাব দেখা গেছে। কিন্তু ইতিহাসের মানদণ্ডে গণমাধ্যমের ত্রুটি সংশোধনযোগ্য—আগুন নয়। ভুলের জবাব হতে পারে প্রতিবেদন, পাল্টা যুক্তি, আদালত বা জনপরিসরের বিতর্ক। আগুন কোনো যুক্তি নয়; এটি যুক্তির সমাধিস্থল।
এই কারণেই প্রেসে আগুন লাগা মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়। এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বয়ানের ওপর আঘাত। কারণ যে সমাজে প্রশ্ন করা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, সে সমাজে সিদ্ধান্তগুলোও অন্ধকারে নেওয়া হয়। সেখানে ক্ষমতা জবাবদিহি হারায়, আর জনগণ ধীরে ধীরে দর্শকে পরিণত হয়।
ইতিহাস তাই আমাদের সামনে কোনো নাটক মঞ্চস্থ করে না, সে শুধু নোট রেখে যায়। ১৯৩৩ সালের বার্লিন, ১৯৭০-এর সান্তিয়াগো, কিংবা আজকের ঢাকা—নোটের ভাষা প্রায় একই। প্রশ্ন একটাই বদলায়: আমরা কি এবারও বলব, ‘এটা আমাদের সঙ্গে হবে না?’
যখন প্রেস পুড়ে যায়, ইতিহাস তখন শুধু কথা বলে না, সে ভবিষ্যতের খসড়া লিখে ফেলে। সেই খসড়ায় হয়তো এখনো শেষ লাইন লেখা হয়নি। কিন্তু আগুনের পর যদি নীরবতা আসে, ইতিহাস জানে, পরের অনুচ্ছেদে কী থাকবে। আর সেই লেখা মুছতে, কালি নয় সময় লাগে, সাহস লাগে, এবং সবচেয়ে বেশি লাগে স্মৃতি।
ইতিহাস ভুলে গেলে নয়, ইতিহাস মনে রাখলেই থামে আগুন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা