রাজনীতি

রোহিঙ্গা ইস্যু : বাংলাদেশকে শক্তি দেখাতে হবে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : রোহিঙ্গা সংকটে বহির্বিশ্বকে পাশে পেতে বাংলাদেশকে সামরিক শক্তি দেখাতে হবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, আজকে বৈশ্বিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শত কান্নাকাটি করে কিছু হবে না, শক্তি দেখাতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করার দরকার নেই, কিন্তু অবশ্যই নিজস্ব ক্ষমতার প্রদর্শন করতে হবে। রোববার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে ‘হোটেল লেকশো’তে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে তারা এই মতামত তুলে ধরেন। ‘মিয়ানমারের গণহত্যা ও বাংলাদেশের ভূমিকা’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে বিএনপি। এতে মূল প্রবন্ধ উপাস্থাপন করেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এম সেরাজুল ইসলাম। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে চোখ রেখে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘সরকারকে বৈশ্বির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুধাবন করে রাষ্ট্রের নিজস্ব শক্তি দেখাতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তা নয়। তবে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বারবার আমার দেশের সীমারেখায় ঢুকে পড়বে আর কিছু বলব না, এটা হতে পারে না। হেলিকপ্টার ভূপাতিত না করলেও গুলি করতে হবে। বোঝাতে হবে আমাদের ক্ষমতা। সবকিছুতেই ভীত হয়ে নরম হলে সবাই পেয়ে বসবে। এখন রোহিঙ্গাদের পাঠানো হচ্ছে, পরবর্তীদের অবৈধ বাংলাদেশি অজুহাতে অন্য প্রতিবেশীরাও অনুপ্রবেশ ঘটাবে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ নোবেল পুরস্কার পেলে সেটি ভালো কিন্তু সেটি সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু এই সরকার বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে দুর্বল করে ফেলছে। অতীতে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তৎকালীন সরকারগুলো যে সফলতা দেখিয়েছে সেই অভিজ্ঞতা নিতে হবে।’ ‘যদি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় সেক্ষেত্রে তাদের অধিকার ফেরত পাইয়ে দিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। আজকে বৈশ্বিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে শত কান্নাকাটি করে কিছু হবে না শক্তি দেখাতে হবে’, বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশের জন্য গভীরতম সংকট অভিহিত করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘অল্প বা মোটামুটি দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কী না-তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকার বলতে পারছে না ঠিক কতদিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে। এর মধ্যে নির্বাচন চলে এলে অনেক রকম খেলা শুরু হবে।’ আগে থেকে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি সহায়তা করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ‘ওইখানে একটা নেতা আছে, যিনি বিভিন্ন চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে খবর এসেছে তিনি অনেক রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গাকে যদি জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয় ভোটে সেটি অনেক প্রভাব ফেলবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলারা চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারত ও চীনের অবস্থান বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের বিকল্প নেই। ভারত ও চীনকে অবশ্যই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলকে ধন্যবাদ যে, তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংকট সমাধানে কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই মন্তব্য করে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হাসান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে।’ রোহিঙ্গারা এদেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। ‘৫ থেকে ১০ বছরের যে রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে তাদের পুনর্বাসন করতে না পারলে তারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। যেহেতু তারা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে না তারা যেকোনো ক্রাইমে জড়িয়ে পড়বে। কারণ তাদের বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা রয়েছে।’ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে বিএনপিকে পৃথকভাবে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বহির্বিশ্বে মিশনে নামতে হবে। সরকার বিএনপির সঙ্গে না এলেও পৃথকভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে।’ অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও পুস্তিকা করার পরামর্শ দেন এবং সব ভাষায় তা অনূদিত করতে বলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে দলটির নেতাদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, এম মোরশেদ খান, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, নিতাই রায় চৌধুরী, সুকোমল বড়ুয়া, মুজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেমিনার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, কুয়েত, ইরান, ফ্রান্স, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ডসসহ মোট ১২টি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকরা অংশ নেন। তবে চীন, ভারত এবং রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম, ব্যারিস্টার নওশাদ জামিল, এম মোর্শেদ খান। সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মাহবুব উল্লাহ, সাংবাদিক কবি আবদুল হাই শিকদার, এম আবদুল্লাহ, এস এম হাসান তালুকদার সেমিনারে অংশ নেন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রেজা/মুশফিক