মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন : নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এবার ভাঙছে কওমি সমর্থিত পুরোনো ইসলামী দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা প্রাক্তন মন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের সঙ্গে দলের আরেক শীর্ষনেতা মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিরোধকে কেন্দ্র করে দলের এই বিভাজন। মূলত নেতৃত্বের বিরোধকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে জমিয়তের জাতীয় কনভেনশন ডেকেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাস। এই কনভেনশনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে ২০ দলীয় জোটের শরিক ইসলামী দলটি। কনভেনশনে জমিয়তের পাল্টা কমিটি গঠন করা হবে। এ ব্যাপারে মুফতি ওয়াক্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ছিলাম। সর্বশেষ দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে আমাকে নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তারা সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে পদ দেন সহ-সভাপতির। যা অগঠনতান্ত্রিক। দলের কিছু নেতা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে আমার পদ-পদবী নিয়ে কুৎসা রটনা করে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জমিয়তের কেন্দ্রীয় আমেলা এবং শুরার যৌথ সভায় সংবিধান ও সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, সহ-সভাপতি মাওলান আব্দুর রব ইউসুফী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুককে সংগঠনের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও তারা জমিয়তের নামে একের পর এক অপকর্ম করতে থাকলে নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে বৃহস্পতিবার জাতীয় কনভেনশন ডাকা হয়েছে। সেখানেই তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। জমিয়তের ভাঙার বিষয়ে আপনাকে দায়ী করা হচ্ছে; এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুয়েমির কারণেই দলের এই অবস্থা। নেতা-কর্মীরা মুফতি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন বলেও তিনি দাবি করেন। তবে জমিয়তের বর্তমান মহাসচিব মুফতি নূর হোসাইন কাসেমি দলের এই অবস্থার জন্য মুফতি ওয়াক্কাসকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম অনেক পুরোনো দল। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী আমাদের সঙ্গে আছেন। কিছু নেতা-কর্মী নিয়ে উনি (মুফতি ওয়াক্কাস) জমিয়তে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছেন। নেতা-কর্মীরা এজন্য ক্ষুব্ধ। আমরা বারবার চেষ্টা করেছি তাকে সংশোধন করতে কিন্তু তিনি আমলে নেননি। নেতা-কর্মীদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে গঠনতন্ত্র না মেনে তিনি জমিয়তকে এককভাবে চালাতে চান। তার কারণে দলে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য। জমিয়তের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিরোধকে কেন্দ্র করে বুধবার দলের সব পদ-পদবি থেকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী অভিযোগ এনে মুফতি ওয়াক্কাসকে বহিষ্কার করেন দলের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমির অনুসারীরা। বুধবার বিকালে পল্টনের নতুন কার্যালয়ে দলের নীতি নির্ধারণী ফোরাম মজলিসে আমেলার বৈঠক ডেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলের নির্বাহী সভাপতি শায়েখ আব্দুল মুমীনের সভাপতিত্বে দলের ১০১ আমেলা সদস্যদের মধ্যে ৩২জন উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে দলের সহ-সভাপতি মাওলানা জহিরুল হক ভুইঁয়া, সহ-সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ওবায়দল্লাহ ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বাসির, মাওলানা মুনীর হোসাইন কাসেমী মাওলানা ফয়জুল হাসান খাদিমানী, মাওলানা খলীলুর রহমান, মাওলানা শিব্বির আহমদ মাওলানা হোসাইন আহমাদ অংশ নেন। বৈঠকে মুফতি ওয়াক্কাসের সঙ্গে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে তার অনুসারী দলের সহ-সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শেখ মুজীবুর রহমানের সদস্যপদও স্থগিত করা হয়। এ ব্যাপারে জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি জানান, দীর্ঘদিন ধরে মুফতি ওয়াক্কাস দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তিনি নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতির মতো দায়িত্বশীল হয়ে কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করে নিজস্ব বলয় তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে কমিটি গঠন করেছেন। যা সুস্পষ্টভাবে সংগঠনবিরোধী। সর্বশেষ তিনি বৃহস্পতিবার দলের কনভেনশন ডেকে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছেন। কাসেমি দাবি করেন, মুফতি ওয়াক্কাসকে সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়, কিন্তু তিনি নিবৃত্ত থাকেননি। বরং সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছেন। তাকে নিয়ম অনুযায়ী শোকজ করা হয়, কিন্তু তিনি জবাব দেননি। তাই মজলিসে আমেলার বৈঠকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার সঙ্গে দলের আরো দুনেতার পদ স্থগিত করা হয়েছে। তিনি মুফতি ওয়াক্কাসের কনভেনশনের খবরে বিভ্রান্ত না হয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে শৃংখলা বজায় রেখে সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তবে জমিয়ত থেকে বহিষ্কারের ব্যাপারে মুফতি ওয়াক্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা নিজেরাই তো গঠনতন্ত্র মানেন না। আমাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হাস্যকর ও অগঠনতান্ত্রিক। তারা মজলিসে আমেলার সিদ্ধান্ত ছাড়াই যখন খুশি যাকে ইচ্ছা পদ দিয়ে দেন আবার পদ থেকে সরিয়ে দেন। আমি কাউন্সিলের মাধ্যমে জমিয়তের নির্বাচিত নির্বাহী সভাপতি। বৃহস্পতিবার দলের কনভেনশন ডাকা হয়েছে। সেখানে নেতা-কর্মীরা সিদ্ধান্ত নেবেন। মুফতি ওয়াক্কাসের অনুসারী দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা অলি উল্লাহ আরমান জানান, কে কাকে বহিষ্কার করে। মুফতি ওয়াক্কাস এই দলের ২৪ বছর মহাসচিব ছিলেন। এখন তিনি নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তার নামেই দলের নিবন্ধন। ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জমিয়তের কেন্দ্রীয় আমেলা এবং শুরার যৌথ সভায় সংবিধান ও সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের দায় জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, সহ-সভাপতি মাওলান আব্দুর রব ইউসুফী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুককে সংগঠনের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অব্যাহতিপ্রাপ্ত মহাসচিবের নেতৃত্বে সভা আহ্বান সম্পূর্ণ অগঠতান্ত্রিক। সুতরাং জমিয়তের নির্বাচিত নির্বাহী সভাপতি প্রাক্তন মন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসকে কথিত বৈঠকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অবৈধ নয়, বরং নির্লজ্জ হাস্যকর তামাশা ছাড়া কিছু নয়। বুধবার বিকেলে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি মজলিসে আমেলার বৈঠক ডাকলেও পল্টনের পুরান কার্যালয়ে পাল্টা মজলিসে আমেলার বৈঠক ডাকেন মুফতি ওয়াক্কাস অনুসারীরাও। দলের সহ-সভাপতি শায়খুল হাদীস মুফতি গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের নির্বাহী সভাপতি, প্রাক্তনমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, সহ সভাপতি মাওলানা মনছুরুল হাসান রায়পুরী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, যুগ্নমহাসচিব মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আব্দুল হক কাউসারী, সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি রেজাউল করীম, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান, মাওলানা আব্দুল মালেক চৌধুরী, মাওলানা বেলায়েত হোসাইন আল-ফিরোজী, মুফতি জাকির হোসাইন খান, মাওলানা উবায়দুল্লাহ, মাওলনা তোফায়েল গাজালি, মাওলনা আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জানুয়ারি ২০১৮/নঈমুদ্দীন/ইভা