রাজনীতি

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। ‘গণতন্ত্র ফেরাতে’ এ জোটের অধীনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুদর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও পেশাজীবীদের এতে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাকি দলগুলো এই নতুন জোটের বাইরে থাকছে। যদিও ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের’ অন্যতম উদ্যোক্তা বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে এই জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। আয়োজকরা জানিয়েছেন, অসুস্থ থাকার কারণে তিনি এই অনুষ্ঠানের যোগ দিতে পারেননি। শনিবার সন্ধ্যায় ৬টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলার হলরুমে অভিন্ন ৭ দফা দাবি এবং ১১ লক্ষ্যের কথা জানিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এর আগে বেলা ৩টা থেকে রাজধানীর মতিঝিলে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ভবনের তৃতীয় তলায় ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। বিকেল ৫টায় রাজধানীর বেইলি রোডে ড. কামাল হোসেনের বাসায় ওই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ড. কামাল হোসেনের বাসায় গিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে যান। এদিকে, ওই সময়ে ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে বৈঠকে করছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। ওই বৈঠকে ছিলেন না যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কামাল হোসেনের চেম্বারে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, ডা. জাফরুরল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব মোস্তফা আমিন, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আব্দুল মালেক রতন, অ্যাডভোকেট আলতাফ হোসেন, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার, আ স ম শফিকুল্লাহ ও মোস্তাক আহমেদ। বৈঠকটি সাড়ে ৫টায় শেষ হয়। সেখান থেকে নেতারা সরাসারি প্রেসক্লাবে আসেন। বৈঠকে না থাকলেও প্রেসক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ৭ দফা দাবি : ১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।

২. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়া।

৩. বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

৪. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল।

৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া।

৬. নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা।

৭. তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ১১টি লক্ষ্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। লক্ষ্যগুলো হলো : ১. মুক্তিসংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ করা।

২. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।

৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।

৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।

৫. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।

৬. জনগণের মৌলিক মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।

৭. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা।

৮. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

৯. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

১০. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’-এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।

১১. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ড. কামাল হোসেন। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ ও খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চলনা করেন ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৮/রেজা/রফিক