বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বুধবার সন্ধ্যায় দেশের উদ্দেশে উড়াল দেবেন।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন জীবনের অবসান ঘটিয়ে তার এই স্বদেশযাত্রাকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে নতুন মাত্রা। এটি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরার প্রস্তুতি নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন দলীয় নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝেও তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ, উদ্দিপনা ও প্রত্যাশা।
লন্ডনের স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ১২টায়) হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করবেন তারেক রহমান। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-২০২ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।
সবকিছু ঠিক থাকলে বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার, একাধিক মামলা, কারাবাস ও শারীরিক অসুস্থতার প্রেক্ষাপটে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান তারেক রহমান। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে একের পর এক মামলায় দণ্ড, আইনি জটিলতা ও অনিশ্চিত বাস্তবতায় দীর্ঘসময় তার দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি। এই সময়টাতে তিনি লন্ডনে অবস্থান করলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনায় সক্রিয় ছিলেন।
আন্দোলন-সংগ্রাম, সাংগঠনিক পুনর্গঠন, রাজনৈতিক কৌশল ও দিকনির্দেশনায় তার ভূমিকা অব্যাহত ছিল, তা দৃশ্যমান।
তারেক রহমানের লন্ডন ছাড়ে দেশে আসার এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক মাহেদ্রক্ষণ হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা। তারা একে ‘রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। তাদের মতে, এটি কেবল ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়; এটি গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রশ্নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, তারেক রহমান দেশে ফিরলে দলের মাঠের রাজনীতিতে পূর্ণ শক্তি ফিরে আসবে এবং নেতৃত্ব কাঠামো আরো সুসংহত হবে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তারেক রহমান শুধু বিএনপিকে নয়, পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন।
তারেক রহমানের লন্ডন ছাড়ার খবরে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ঢাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথকে ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের একাধিক ইউনিট এই ঘটনাকে ‘হাই সেনসিটিভ’ হিসেবে বিবেচনা করছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ আচরণ, শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা সংঘাতের সুযোগ দেওয়া হবে না।
অনেকের মতে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও তিনি দলের কার্যকর নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে বিএনপি দাবি করে আসছে। এবার সরাসরি দেশে থেকে রাজনীতি পরিচালনা করলে নির্বাচনি কৌশল, প্রার্থী বাছাই, জোট রাজনীতি এবং আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণে তার ভূমিকা আরো দৃশ্যমান হবে। ক্ষমতাসীনদের জন্যও একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে ঘিরে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে তৈরি হয়েছে আবেগঘন পরিবেশ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা একে দীর্ঘঅপেক্ষার অবসান হিসেবে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘসময় পর তারা এমন একজন নেতাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পাবেন, যিনি তাদের আন্দোলনের প্রতীক।
সংগীত শিল্প ন্যান্সির একটি গান প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুকে তারকে রহমানকে স্বাগত জানিয়ে প্রকাশ করা গানটির কথা রয়েছে, “স্বাগতম স্বাগতম স্বাগতম/বাংলাদেশ তোমায় করছে বরণ... নেতা আসছে নেতা আসছে/ মা মাটি মানুষের কাছে/ যেন বাংলাদেশ হাসছে/ তার সূর্য সন্তান আসছে...।”
তবে আবেগের পাশাপাশি রয়েছে বাস্তব প্রত্যাশাও। দলীয় নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, তারেক রহমানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিএনপিকে কীভাবে আরও সংগঠিত করা হবে, নির্বাচনকালীন রাজনীতি কোন পথে এগোবে, রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কী ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে- এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য সবাই এখন তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তারেক রহমানের দেশ গঠনের বিভিন্ন বার্তা পোস্ট করা হচ্ছে। এমন একটি বার্তায় বলা হয়েছে, “দক্ষ যুবশক্তি ও বেকারত্বহীন বাংলাদেশ গড়তে ধানের শীষে ভোট দিন।” আবার বলা হচ্ছে, “কৃষকের অধিকার ফিরিয়ে আনতে ধানের শীষে ভোট দিন।”
এমন সব বার্তা দেওয়ার আগেই তারেক রহমান তার একাধিক বক্তব্যে এসব বিষয়ে তার নীতি ও পরিকল্পনা তুলে ধরে জনগণের ভোটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি নেতাকর্মী ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও তারেক রহমানের লন্ডন ছাড়াকে ঘিরে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এটিকে দীর্ঘ প্রবাসজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাপ্তি হিসেবে দেখছেন।
মালয়েশিয়া অবস্থানরত একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধা শাহিন আলম ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তিনি তার ভোটটি ধানের শীষে দেবেন। তিনি অনুরোধ করেছেন, “প্রবাসীদের প্রথম ভোট, ধানের শীষের পক্ষে হোক।” এটি বিএনপির অন্যতম স্লোগান।
তারেক রহমানের সঙ্গে তার কন্যা জাইমা রহমান আসছেন। এক বার্তায় তিনি বলেছেন, “লন্ডনের দিনগুলো আমাকে বাস্তববাদী করেছে, একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। যদিও আমার হৃদয়-মন সব সময় বাংলাদেশেই ছিল।” তিনি আরো লিখেছেন, “একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দেশের জন্য সর্বস্ব দিয়ে সর্বোচ্চ লড়তে চাই।”
দেশে ফেরার পর তারেক রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচি, দলীয় পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ নিয়ে ইতোমধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, দেশে পৌঁছানোর পর শিগগির তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসবেন এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন।
শিল্পী নাসিরের কণ্ঠে আরেকটি গান ছেড়েছে বিএনপি। গানের কথায় রয়েছে, “স্বাগতম/ তারেক জিয়ার আগমন/ শুভেচ্ছা আর স্বাগতম...।”
তারেক রহমানকে গণসংবর্ধনা দিতে রাজধানীর ৩০০ ফিটে বিশাল মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই মঞ্চ ঘিরে প্রত্যাশার বারতা নিয়ে জমায়েত হবেন লাখ লাখ মানুষ।
১৭ বছরের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে বুধবার লন্ডন ছাড়ার এই মুহূর্ত তাই শুধু একটি ফ্লাইটের সময়সূচি নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই প্রত্যাবর্তন রাজনীতির গতিপথকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা নির্ধারণ করবে সময়ই।