দীর্ঘ ১৭ বছর পর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাকে স্বাগত জানাতে রাজধানীতে জড়ো হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। দেশে ফিরেই গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। তারেক রহমানের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে তার দেশ গড়ার পরিকল্পনা। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথাও।
বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফিটে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেছেন, “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান।”অর্থাৎ, আমার একটি পরিকল্পনা আছে।
এদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারেক রহমানকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর পর বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে তিনি একটি বিশেষ বাসে করে ৩০০ ফিটের উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে তার জন্য প্রস্তুত ছিল সংবর্ধনা মঞ্চ। বাসে করে ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর মঞ্চে পৌঁছান বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য শুরু করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন,“প্রিয় বাংলাদেশ, মঞ্চে উপস্থিত প্রিয় মুরুব্বিবর্গ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, আমার সামনে উপস্থিত প্রিয় ভাই ও বোনেরা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে যারা এই অনুষ্ঠান দেখছেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, প্রিয় মা ও বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম।”
মার্টিন লুথার কিংয়ের ঐতিহাসিক বক্তব্য স্মরণ করে তারেক রহমান বলেন, “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি।“ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের প্রতিটি মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আজ তিনি রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাজারো লক্ষ কোটি শুকরিয়া জানাতে চান। রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমত ও দেশবাসীর দোয়ায় তিনি আবার তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছেন।
তারেক রহমান বলেন, “আমরা যে ধর্মেরই হই, যে শ্রেণিরই হই, যে দলেরই রাজনৈতিক কর্মী হই বা নির্দলীয় মানুষ হই—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আসুন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, সবাই মিলে আজ আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। সবাই মিলে করব কাজ।”
তারেক রহমান বলেন, “বাংলাদেশের এই প্রিয় মাতৃভূমি ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের পর ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে আনে। কিন্তু, এরপরও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আবারও ১৯৭১-এর মতোই ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ, মাদ্রাসার ছাত্রসহ দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “আজ বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায় এবং যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। আজ আমাদের সময় এসেছে সকলে মিলে দেশ গড়ার।”
নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি বলেন, “এই দেশে পাহাড়ি মানুষ যেমন আছে, তেমনই সমতলের মানুষও আছে। মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু—সব ধর্মের মানুষ এখানে বসবাস করে। সবাইকে নিয়ে এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন—একটি নিরাপদ বাংলাদেশ। যেখানে নারী, পুরুষ বা শিশু যে-ই হোক না কেন, নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে।”
বিএনপির শীর্ষ নেতা বলেন, “দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, ৪ কোটিরও বেশি তরুণ, প্রায় ৫ কোটি শিশু, প্রায় ৪০ লাখ প্রতিবন্ধী এবং কয়েক কোটি কৃষক-শ্রমিক রয়েছেন। এই সকল মানুষের রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা আছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে এই প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব।”
তারেক রহমান বলেন, “১৯৭১ সালের শহীদরা এমন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিগত ১৫ বছরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বহু মানুষ গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালেও তরুণ প্রজন্মের অনেকে জীবন দিয়েছেন। সম্প্রতি চব্বিশের আন্দোলনের সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি শহিদ হয়েছেন গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।”
ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ধৈর্যের আহ্বান তিনি বলেন, আধিপত্যবাদী শক্তির ভক্ত-চররা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ অবস্থায় ধৈর্য ধরতে হবে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মকেই আগামী দিনে দেশ গড়ার নেতৃত্ব নিতে হবে। গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দেশ গড়তে হবে।
মঞ্চে উপস্থিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি ইঙ্গিত করে তারেক রহমান বলেন, “সবাই মিলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে, যাতে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়া যায়।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যেকোনো মূল্যে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। আমরা দেশের শান্তি চাই।”
মায়ের কাছে যাওয়ার আগে দেশবাসীর প্রতি কথা তারেক রহমান জানান, তিনি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে সরাসরি তার মা, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যাবেন।
তিনি বলেন, “এই মানুষটি এই দেশের মাটি ও মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন।”
তার সঙ্গে কী হয়েছে, তা দেশবাসী সবাই জানে, উল্লেখ করে তিনি সন্তান হিসেবে দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানান, খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য যেন সবাই আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন।
তারেক রহমান বলেন, একজন সন্তান হিসেবে তার মন পড়ে আছে হাসপাতালের সেই ঘরে, মায়ের শয্যার পাশে। তবে, যাদের জন্য খালেদা জিয়া নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, এই দেশের মানুষকে তিনি কোনোভাবেই ফেলে যেতে পারেন না। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই হাসপাতালে যাওয়ার আগে তিনি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এই মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন।
আল্লাহর দরবারে সম্মিলিত প্রার্থনা তারেক রহমান বলেন, “আসুন, আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি।”
তিনি আল্লাহকে একমাত্র মালিক, পরোয়ারদিগার, রহমতদানকারী ও সাহায্যকারী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, যদি আল্লাহ রহমত দেন, তাহলে এ দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে। আল্লাহর রহমত ও সাহায্য যদি দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে থাকে, তবে ইনশাআল্লাহ একটি কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
ভবিষ্যতে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসবেন, তারা যেন নবী করিম হজরত মুহাম্মদের (সা.) ন্যায়পরায়নতার আদর্শ অনুসরণ করে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, এই অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন তারেক রহমান।