আনু মোস্তফাঢাকা, ৩ আগস্ট: ইতিহাসের কাঠগড়ায় এখন জামায়াত। রাজনৈতিক দল হিসেবে বৃহস্পতিবার দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এ রায় দেন। রায়ের ফলে জামায়াত দলগতভাবে ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার অধিকার হারালো।
রায় ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশনের কৌসুলি মহসিন রশীদ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ের ফলে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত এখন আর কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, আলোচিত রায়ের ফলে জামায়াতকে এদেশে নিষিদ্ধের বিষয়টি সহজ হলো।
তিনি আরও বলেন, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। জন্মের পর এই নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে উপমহাদেশে ৪ বার নিষিদ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে একবার, পাকিস্তানে দু’বার ও ভারতে একবার।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত জামায়াত নেতাদের ৬টি মামলার রায়েই জামায়াতকে অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। উল্লেখ করা হয়েছে সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে।
একাত্তরে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদ্বয়কালে মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচার হত্যা করে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। মানুষের সহায় সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়াও সর্বাত্মকভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় তারা।
দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে জামায়াত ও স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বিচার চলছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু রায় হয়ে গেছে। অপেক্ষায় আরও কয়েকটি।
বিতর্কের মধ্যেই জন্ম জামায়াতেরবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার পূর্বনাম ছিলো জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী সূচিত সংগঠনটির মূল নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এর প্রতিষ্ঠা।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানীর অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারো নিষিদ্ধ হয়। দলের প্রধান মওদুদীসহ গ্রেফতার করা হয় ৬০ জামায়াত নেতাকে।
এই ৬০ জনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের যে ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন তাদের অন্যতম গোলাম আযম। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ মামলায় ৯০ বছরের দণ্ড হয়েছে তার।
মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভুমিকা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে দলটির সদস্যরা হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ ডিসেম্বর ডিসেম্বর বুধিজীবী হত্যকান্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়।
দেশ স্বাধীন হলে দলটির প্রধান গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান ও বাকিদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়।
স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামী
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এই বছরেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে এই বিবেচনায় জামায়াতও রাজনীতির অধিকার হারায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃসংশভাবে নিহত হলে জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৭৬ সালের আগষ্টে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামের একটি দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে।
জেনারেল জিয়ার সরকার এসময় গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে।
মহাসঙ্কটে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আদালতের আদেশ পর্যালোচনা করে আইনজ্ঞরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য ও বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের সংবিধানের অবস্থান সাংঘর্ষিক। এটি আইনের বিষয়। চাইলেও জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারবেন না।
বিশিষ্ট আইনবিদ ব্যারিষ্টার আমীরুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াত দেশের সংবিধানকে স্বীকার করে না। দলের নিবন্ধন বাতিল করার বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধিত) অ্যাক্ট-২০০৯ এর ধারা ৯০-এইচের ‘বি’তে বলা হয়েছে, সরকার কোনো দল নিষিদ্ধ করলে সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করবে কমিশন।
একই ধারার উপধারা ‘সি’তে বলা হয়েছে, দেশের সংবিধানের সঙ্গে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হলে সেই দলের নিবন্ধন থাকবে না বা নতুন করে নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে জামায়াত নামের কোন দল নির্বাচন করতে পারবে না। তবে জামায়াতের নেতারা ব্যক্তিগতভাবে কেউ চাইলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
তিনি বলেন, আদালত জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করলেও তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নিবন্ধন নেই এমন অনেক দলই বাংলাদেশে রাজনীতি করে। এখানে জামায়াতও রাজনীতি করতে পারবে।
জোরালো হচ্ছে জামায়াতের সকল কমর্কাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি
মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি মামলাতেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনা বাহিনীর পক্ষে জামায়াতের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে দলটির নেতাকর্মীদেরকে কোনো ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনে না নেওয়ারও অনুরোধ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ অবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধী দলটির নিবন্ধন বাতিলও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।
তিনি বলেন,‘নিবন্ধন বাতিলের পরও জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তবে সরকার চাইলে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারেন। আমরা চাই সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে।
নিবন্ধন বাতিল করায় জনগণের কাছে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। মনে করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
তিনি বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধে এখন সরকারের ওপর চাপ বেড়ে গেল। যেটা সরকার এড়াতে পারবে না। কারণ, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
জামায়াতকে কি নিষিদ্ধ সম্ভব
ব্যাপক অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডের দায়ে জামায়াতে ইসলামী এরইমধ্যে অভিযুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন মাত্রায় দণ্ডিত হয়েছেন দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। দলটির অতীত কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রেখে চলেছে বর্তমান নেতৃত্ব। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে শুরু করে এখনও কারণে অকারণে নৃসংশ ও সহিংস হয়ে উঠছে দলটির নেতাকর্মীরা ।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির গত কয়েক দশকে শিক্ষাঙ্গণে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। নৃসংশতার চরম পর্যায় সৃষ্টি করে জনমানসে গভীর ভীতির সঞ্চার করে তারা। পায়ের রগ কর্তন থেকে শুরু করে কুপিয়ে হত্যার বীভৎস নজির শিবিরই স্থাপন করেছে দেশে।
অন্যদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দেশব্যাপী জামায়াতের ভয়াবহ সহিংসতা দেখে মানুষ। যা একাত্তরে দলটির নৃসংশ ভুমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
দলটির নেতাকর্মীরা এখনও সুযোগ পেলেই হয়ে উঠছে হিংস্র। ফলে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জোরালই হচ্ছে। অনেকেই বলেছেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দলটির অতীত অপরাধের ভুমিকা ইতিহাসের দায় থেকে মু্ক্তি পাবে না।
জামায়াতের মত দলের এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। দেশের নতুন প্রজন্ম এখন চাইছে দেশ থেকে জামায়াতের রাজনীতির ইতি ঘটুক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল কাশেম মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীতে নাৎসি বাহিনীর ভয়াবহ নৃসংশতার কথা সবাই জানেন। এই দলটি কিন্তু জার্মানীতে এখন্ও রাজনীতি বা প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না। এমনকি নাৎসি বাহিনীর প্রতীক স্বস্তিকাও জার্মানীতে প্রকাশ্যে প্রদর্শন নিষিদ্ধ।
তাঁর মতে, হিটলারের নাৎসি দলটির সঙ্গে জামায়াতের অপরাধ কর্মকাণ্ডের অনেক মিল। উভয় দলই নিজ নিজে দেশে মানবতার চরম অবমাননা করেছে।
তিনি আরও বলেন, জার্মানীতে নাৎসি দলটিকে নির্মূল করা হয় একটি বিশদ পরিকল্পনার মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে বড় করা হয়েছে। তবে আশার কথা- স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারটা শুরু হয়েছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাও সম্ভব-যদি ক্ষমতাসীন দলটির চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ থাকে।
রাইজিংবিডি / কেএস / এলএ