পজিটিভ বাংলাদেশ

পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত কার্বন রপ্তানি হচ্ছে চীনে

পাবনা প্রতিনিধি : যে পাটখড়ি শুধু গরিবের জ্বালানি আর ঘরের বেড়া দেওয়ার কাজে লাগত, সেই পাটখড়ি এবার আনছে বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের পাটখড়ি থেকে তৈরি কার্বন পাউডার বা চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীনে। ইতিমধ্যে সারা দেশে পাটখড়ি থেকে কার্বন তৈরির ২৫টি কারখানা গড়ে উঠেছে। যার দুটি কারখানা রয়েছে পাবনায়। উদ্যোক্তারা জানান, গত ছয় মাস ধরে এখান থেকে কার্বন বা চারকোল তৈরি ও রপ্তানি হচ্ছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, পাটখড়ির কার্বন দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। বাড়ছে কর্মসংস্থানও। জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বিশেষ চুল্লিতে জ্বালানো হচ্ছে পাটখড়ি

 

দেশে পাট আবাদের ফলন নিয়ে জোয়ার-ভাটার টানে কখনও লাভ, কখনও বা ভাল দাম না পাওয়ার হতাশায় ভোগেন পাটচাষিরা। আর পাটখড়ির খবর কজনই বা রাখেন। ঘরের বেড়া কিংবা রান্নার জ্বালানি ছাড়া তেমন কোনো কাজে লাগত না। কিন্তু অবহেলিত পাটখড়িই এবার আনছে বৈদেশিক মুদ্রা। পাটখড়ি থেকে তৈরি কার্বন পাউডার বা চারকোল রপ্তানি করা হচ্ছে চীনে। দিন দিন বাড়ছে এ পণ্যের রপ্তানি। চার বছর আগে পাটখড়িকে কার্বন বানিয়ে রপ্তানির পথ দেখান ‘ওয়াং ফেই’ নামের এক চীনা নাগরিক। তার দেখানো পথে দেশে বর্তমানে কার্বন তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে ২৫টি। এর মধ্যে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার নরজান গ্রামে ও বেড়া উপজেলার নগরবাড়ি এলাকায় যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে দুটি কারখানা।

পাটখড়ি জ্বালানো কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা

 

এস জে জে কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কার্বন উৎপাদনে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় কারখানা রয়েছে পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে চীনে রপ্তানি হলেও আগামীতে অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হওয়ার আশা তাদের। আটঘরিয়া উপজেলার নরজান গ্রামে অবস্থিত এস জে জে জয়েন্ট কোম্পানির ম্যানেজার মো. ওয়াহেদুজ্জামান জানান, গত মে মাস থেকে আমরা পরীক্ষামূলক উৎপাদনে গেছি। বিশেষ চুল্লিতে পাটখড়ি পুড়িয়ে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টন কার্বন। প্রাথমিক অবস্থায় গত ছয় মাসে তারা ১১০ টন কার্বন রপ্তানি করা হয়েছে। ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়বে। তিনি আরো জানান, এখান থেকে উৎপাদন হওয়ার পর ট্রাকযোগে চট্রগ্রাম যায়, সেখান পোর্টে চীনে রপ্তানি হচ্ছে। পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও রপ্তানি করা হবে। তিনি আরো জানান, কার্বন দিয়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ, কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, প্রসাধন পণ্যসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় পাটখড়ির কার্বন। কারখানায় বর্তমানে স্থানীয় ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ভবিষ্যতে কারখানা বৃহৎ পরিসরে করার পরিকল্পনা আছে। কার্বন তৈরি সম্পর্কে ওয়াহেদুজ্জামান জানান, পাটখড়ি এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিনে আনা হয়। এরপর সেগুলো বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুন জ্বালানো হয়। তারপর ১০-১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লিটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে কোনোভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চার দিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ক্র্যাশিং করে কার্বন প্যাক করা হয়। সুপারভাইজার জয়নুল আবেদীন বলেন, কারখানায় কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। ফলে কারখানাটি পরিবেশবান্ধব রয়েছে। আমরা কার্বন বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছি। এতে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে। তবে আমাদের কারখানায় যাতায়াতের রাস্তাটি কাঁচা। ফলে পাটখড়ি আনা নেওয়া ও কার্বন পরিবহনে খরচ বেশি পড়ছে। রাস্তাটি দ্রুত পাকা করা হলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে। এদিকে পাবনার কারখানায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। পাটখড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের পাট চাষে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন তারা। কয়েকজন কারখানার শ্রমিক জানান, বেকার অনেকে এখানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। অন্য জায়গায় কাজ করতে গেলে যাতায়াতের খরচ দিয়ে মজুরি তেমন থাকত না। এই কারখানাটি বাড়ির কাছে হওয়ায় আমাদের খুব উপকার হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, পাটখড়ির তেমন মূল্য পাওয়া যেত না। কারখানা হওয়ায় পাটখড়ির ভাল দাম পাওয়া যাবে, এজন্য পাট চাষ আরো বাড়বে।

প্যাক করা হচ্ছে কার্বন

 

এ বিষয়ে পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহসভাপতি মাহবুব উল আলম মুকুল বলেন, পাটখড়ি থেকে কার্বন তৈরির কারখানার মাধ্যমে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই পাটখড়ির কার্বন। তাই সরকার উদ্যোক্তাদের নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে এমন কারখানা আরো বাড়বে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, পাটখড়ির কার্বন বা চারকোল রপ্তানিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৪ কোটি টাকা রপ্তানি আয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (প্রস্তাবিত) সূত্র মতে, বাস্তবে এ খাত থেকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা। আর সহজেই আয় হওয়া সম্ভব বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পাট অধিদপ্তরের সূত্র মতে, দেশে বছরে পাটখড়ি উৎপাদন হয় ৩০ লাখ টন। এর ৫০ শতাংশকেও যদি কার্বন করা যায় তাহলে দেশে বছরে উৎপাদন দাঁড়াবে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। এ খাত থেকে বছরে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে ৩২ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আর সরকার এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব পাবে ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। রাইজিংবিডি/পাবনা/১৯ ডিসেম্বর ২০১৬/শাহীন রহমান/রিশিত