পজিটিভ বাংলাদেশ

অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ারে উপকূল

বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। সমুদ্র-নদী থেকে আহরিত মৎস্য সম্পদে জীবিকা চলে লাখো মানুষের। লবণ চাষ, শুঁটকি উৎপাদন, কাঁকড়া চাষ, চিংড়ি চাষে জীবিকা চলে বহু মানুষের। দ্বীপের পলি মাটিতে কৃষি আবাদ বহু মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। সয়াবিনের মতো অর্থকরী ফসল উৎপাদনেও বিপ্লব ঘটেছে উপকূলে। সমুদ্র সৈকতের খনিজ বালু এই জনপদের আরেক সম্ভাবনা। পর্যটন খাতেও উপকূলজুড়ে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। এসব সম্ভাবনা ও সম্ভাবনা বিকাশের অন্তরায় উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে তুলে ধরেছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু। আজ প্রকাশিত হলো এই ধারাবাহিকের সূচনা পর্ব।    বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্ররেখা বরাবর ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চলে অফুরন্ত সম্ভাবনার সুযোগ থাকলেও বহুমূখী প্রতিবন্ধকতায় সেই সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ তেমন মিলছে না। একদিকে ঝড়-ঝাপটার তাণ্ডবসহ নানামূখী প্রাকৃতিক বিপদ, অন্যদিকে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলো আলোর মুখ দেখছে না।   সূত্রগুলো বলছে, উপকূল অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক অনেক শিল্প-সম্ভাবনা রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চিংড়ি চাষ, কাঁকড়া চাষ, লবণ চাষ, শুঁটকি উৎপাদন, ঝিনুক চাষ, মুক্তা চাষ এমনকি গবাদি পশু ও দুগ্ধ খামারের মতো শিল্প। এলাকাভিত্তিক কৃষি উন্নয়নের প্রকল্প যেমন হতে পারে, তেমনি কৃষিভিত্তিক শিল্পও হতে পারে। পরিবহন ও পর্যটনেও রয়েছে সম্ভাবনা। সমুদ্র সৈকতে খনিজ বালুর যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি সমুদ্রের তলদেশেও রয়েছে অফুরন্ত সম্পদ। এসব শিল্প শুধু উপকূল নয়, বাংলাদেশের জন্য বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু বহুমূখী প্রতিবন্ধকতায় এসব সম্ভাবনার সুফল মিলছে না। জানা গেছে, পলি মাটি জমে ক্রমাগত ঊর্বর হয়ে উঠছে উপকূলের মাটি। নদীর বুকে গড়ে ওঠা চরগুলোতে হচ্ছে নানা জাতের ফসল। জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তুলছে। চিংড়ি চাষ, মাছ চাষের মতো ঝুঁকিও নিচ্ছে কেউ কেউ। এগুলোর ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা নেই বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। 

 

উপকূলের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপের রহমতপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সমুদ্রের রূপালি মাছ মৎস্যজীবীর মুখে হাসি ফোটায়, মাঠের সোনালী ধান চাষির ঘরে এনে দেয় আনন্দ। প্রকৃতির সঙ্গে যেন নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে উপকূলের মানুষের। হাজারো ভয়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে উপকূলের সংগ্রামী মানুষগুলো সকল সম্ভাবনার মাঝেই জীবিকার পথ খোঁজে। কিন্তু পদে পদে তারা বিপদের মুখে পড়ে।’ ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়ার মৎস্যজীবী খলিলুর রহমান বলেন, ‘প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো কেবলই সম্ভাবনার পথ খোঁজেন। পরিবার পরিজনের মুখে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেষ্টায় সামিল হন। কিন্তু প্রতিনিয়ত উজানে চলা মানুষেরা বার বার মার খায়। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে এখানকার মানুষ যে ভালোভাবে বেঁচে থাকবে, সে সুযোগ কোথায়। সরকারের তো এ বিষয়ে নজর নেই।’ উপকূলের সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীদের সাথে আলাপেও উঠে এসেছে একই চিত্র। আলাপকালে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার জন্য দরকার যথাযথ পরিকল্পনা। কিন্তু তেমনটা দেখা যায় না। এ বিষয়ে প্রণীত আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেকে বলেন, উপকূলে অফুরন্ত সম্ভাবনার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও সম্ভাবনা বিকাশে বিশেষ কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।   স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সমুদ্র বা উপকূলের সম্পদের মধ্যে অন্যতম মৎস্য। এক হিসাবে জানা যায়, উপকূলের ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মাছ ধরার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। সমুদ্রে মাছ ধরায় প্রযুক্তিগত সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মৎস্যজীবীদের আর্থিক সংকট। কলাপাড়ার মৎস্যজীবী সেকান্দার আলী বলেন, ‘মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে হয়। এর ওপর আমার ঘরে ফেরার নিশ্চয়তাও নেই। ঝড়ের কবলে পড়ে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরতে পারলে কিংবা দস্যুদের আক্রমণে জীবন গেলে আমার পরিবারের দায়িত্ব কেউ নেবে না। দাদনদারের টাকায় আটকা পরি আমরা। মহাজনের ঋণের টাকা শোধ করতে হলে জেলেকে সমুদ্রে যেতে হবে। তাই সব ভয় উপেক্ষা করেই আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে বা নদীতে মাছ ধরতে যেতে বাধ্য হই।’ জানা গেছে, মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অন্যতম মাধ্যম বলে ধরা হলেও এ ক্ষেত্রেও নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। প্রতি বছর পহেলা মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। আবার ২৫ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর ১৫ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার আদেশ আসে। এছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। নিষিদ্ধ জাল আটকে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। এইসব অভিযান কিংবা নিষেধাজ্ঞায় পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের পুনর্বাসনে সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ জেলে এ সহায়তা পান না। অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সাধারণ জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিহুন্দি জাল কিংবা বেড় জালের আধিপত্য রয়েই যায়। তাদের লাগাম টানা যায় না। অথচ এই দুই প্রকারের জালই সকল মাছের পোনা ধ্বংস করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র বিহুন্দি আর বেড় জাল বন্ধ করা সম্ভব হলে কোনো অভিযানই প্রয়োজন হবে না। জেলেরা মাছ ধরে শেষ করতে পারবে না। খুলে যাবে মৎস্য খাতের বিরাট সম্ভাবনা। উপকূলে শুঁটকি উৎপাদনের বৃহৎ একটি ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও সেভাবে বিকাশ ঘটছে না। শীত মৌসুম এলে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়ে যায়। যার কাঁচামাল বা মূল উপাদান আসে জেলেদের ট্রলার-নৌকা থেকে। কক্সবাজারের নাজিরের টেক, মহেশখালীর সোনাদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, বাগেরহাটের মংলার নিকটে দুবলার চরে শুঁটকি তৈরির বেশকিছু পল্লী গড়ে উঠেছে। সমুদ্র-নদীতে মাছ পাওয়া গেলে শুঁটকি পল্লীগুলোতে কাজের চাপ বাড়ে, আর মাছের অভাব দেখা দিলে সেখানেও সংকট লেগে যায়। শুঁটকি পল্লীতে কর্মরত হাজারো শ্রমিক তখন সংকটে পড়েন। কাউকে ফিরতে হয় অন্য কাজে। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ খাতে রয়েছে হাজারো সংকট। তাদের কথায়, জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে বাজারজাতকরণে সমস্যা। কখনো লাভজনক মূল্য না পাওয়া, আবার কখনো শুঁটকি পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি। এসব বাঁধা অতিক্রম করে শুঁটকির উৎৎদন বাড়ানো কিংবা এর বাজার সম্প্রসারণ অনেকটাই চ্যালেঞ্জের।

 

পূর্ব উপকূলে, বিশেষ করে কক্সবাজার, চকোরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, বাঁশখালীর মাঠে মাঠে লবণের চাষ চোখে পড়ে। বিশাল মাঠের এক কোণে হয়তো ধান কিংবা অন্য ফসলের আবাদ; কিন্তু অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে লবণ। চাষিরা বংশ পরম্পরায় লবণের চাষ করছেন। জমি বর্গা নিয়ে কিংবা কেউ কেউ নিজের জমিতে আবাদ করেন লবণ। বহু মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এই শিল্পে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা বিকাশেও নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। সূত্র বলছে, উপকূলের সম্ভাবনা বিকাশে বিভিন্ন ধরনের আইন ও নীতিমালার পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে উপকূলের উন্নয়নে ২০০৫ সালে তৈরি হয়েছিল একটি পলিসি। বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস সরকারের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের অধীনে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে কোস্টাল জোন পলিসি তৈরি হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে কোস্টাল জোন পলিসি-২০০৫ এর ৪.১ (ক) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ‘দারিদ্র্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্যে বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ।’ অন্যদিকে একই পলিসির ৪.১ (খ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাপ্ত সুযোগের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সাগরের মাছ, লবণ চাষ, শুঁটকি, চিংড়ি চাষ, কাঁকড়া চাষ, ঝিনুক চাষ, মুক্তা চাষ, গবাদি পশুর উন্নয়ন, এলাকাভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প, পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজভাঙা, পর্যটন, সমুদ্র সৈকতের খনিজ আহরণ, নবায়নযোগ্য বা অনবায়নযোগ্য শক্তি প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিদ্যমান সুযোগ কাজে লাগানো।’ কিন্তু এই পলিসির কোনো প্রতিফলন কোথাও নেই। অনেক সরকারি দপ্তর পলিসি সম্পর্কে তেমনটা ওয়াকিবহালও নন। উপকূলের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মাহবুব মোর্শেদ লিটন বলেন, উপকূলের সম্পদ আহরণ এবং সম্পদের সুষম ব্যবহারের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এখানে অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকলেও সে সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে যদিও আমাদের কিছুই করার নেই। তবুও এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আর পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে হবে মানুষ। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের কণ্ঠস্বর পরিকল্পনায় তুলে আনতে সব ব্যবস্থা নিতে হবে। তা হলেই উপকূলের সম্ভাবনা বিকশিত হবে।’ লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, উপকূলের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি এই অঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনা বিকাশে সরকারের নজর রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ বিষয়ে পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা