পজিটিভ বাংলাদেশ

ঢালচরে অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরফ্যাশনের ঢালচর ঘুরে : ভাঙনসহ বহুমুখী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে থাকা দ্বীপ ঢালচরে অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি। দ্বীপের দক্ষিণে প্রায় ৫০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে জাগছে বিশাল আকৃতির চর। ভাটায় এইসব চর জেগে ওঠে। বর্ষায় কিছু চর জোয়ারে ডুবলেও শুকনো মৌসুমে অধিকাংশ চর জোয়ারের পানি থেকে অনেক উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। দ্বীপের একাধিক স্থানে সমুদ্র সৈকত আকৃষ্ট করছে পর্যটকদের। স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, গত কয়েক বছরে ঢালচরের দক্ষিণে প্রায় ২০টি ছোট-বড় চর জেগেছে। ভাটার সময়ে এসব চরে জেলেরা তাদের নৌকা নোঙর করে। এর মধ্যে কিছু চর শুকনো মৌসুমে একেবারেই জেগে যায়। জেগে ওঠা চরগুলোর মধ্যে লালচর, পঁয়ষট্টির চর, রাস্তার চর, কালাম মাঝির চর, রশিদ মাঝির চর, মহিউদ্দিন মাঝির চর, শফি হাওলাদারের চর, বাবুল মাঝির চর, মোতাহার মাঝির চর, সেলিম পাটোয়ারির চর, তিনচর, তৈয়ব মাঝির চর, জাফর মাঝির চর, ভাসানচর, বগারচরসহ বেশ কয়েকটি চরের নাম পাওয়া যায়। বন বিভাগ এসব চরে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিলে অচিরেই এসব চর শক্ত ভূমিতে পরিণত হতে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। তবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই চরগুলো এখনও গাছের চারা লাগানোর মতো উপযোগী হয়নি। এখন গাছ লাগানো হলে জোয়ারের পানিতে তা ভেসে যাবে। চরগুলো আরও একটু জেগে উঠলে গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

ঢালচরের দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে তারুয়া সমুদ্র সৈকত। এ সৈকত এরই মধ্যে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। নয়নাভিরাম এই সমুদ্র সৈকত ঘিরে এখানে রয়েছে পর্যটন বিকাশের অফুরন্ত সম্ভাবনা। শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এখানে পর্যটকদের আসা সম্ভব হচ্ছে না। ভোলা জেলা সদর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক পার হওয়ার পর নদীপথে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর এই তারুয়া সমুদ্র সৈকত। যেখানে রয়েছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে এই সৈকত। বালুকাময় মরু মেঠো পথের পাশে বৃহৎ ম্যানগ্রোভের ছায়াপথে মনোরম পরিবেশে সময় কাটাতে পারেন পর্যটকেরা। রয়েছে হরিণের বিচরণভূমি। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে তার অপার সৌন্দর্য্য। সকাল-দুপুর-বিকেলে তারুয়া সমুদ্র সৈকত ঘিরে এখানে বিরাজ করে ভিন্ন এক নান্দনিক সৌন্দর্য্য; যা যে কোন পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পারে। বনে হরিণের ছুটাছুটি আর পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। শীতে সৈকতে বসে অতিথি পাখিদের মেলা। সৈকতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি ভিন্ন সৌন্দর্য্যরে সৃষ্টি করে। সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে ঘন ম্যানগ্রোভ বনের সখ্য এখানে এনে দিয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্য্য। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তারুয়া সৈকতে ভ্রমণের জন্য নেই নির্ধারিত কোন নৌযান। বিশেষ ব্যবস্থায় কিংবা রিজার্ভ করা স্পিড বোট, ট্রলার বা ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করে সৈকতে যেতে হয় পর্যটকদের। সৈকতে নামার জন্য কোন পন্টুন বা টার্মিনাল নেই। নেই রাতে থাকার ব্যবস্থা। ফলে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও পর্যটকরা সেখানে যেতে পারেন না। প্রকৃতির টানে যারা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে তারুয়া সৈকতে যান, তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

 

তারুয়া সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের দাবি, চরফ্যাশনের মূল ভূ-খণ্ড থেকে তারুয়া দ্বীপে সরাসরি সী-ট্রাকের ব্যবস্থা থাকলে অতি সহজে সৈকতে ভ্রমণ করা যায়। এখন কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রলার ঢালচর পৌঁছাতেই সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। সেখান থেকে তারুয়া পৌঁছাতে আরও সময় লাগে। অনেক কষ্টে সৈকতে পৌঁছাতে পারলেও সেখানে নেই পানীয় জল কিংবা থাকার ব্যবস্থা। নিরপত্তার ব্যবস্থাও নেই। সংশ্লিষ্টদের দাবি অনুযায়ী, পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য এখানে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং থাকা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার জরুরি। এরসঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হলে নির্বিঘ্নে তারুয়া সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকেরা। ফলে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে, তেমনি ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা পাবেন নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের সুযোগ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ঢালচরে এত চমৎকার একটি সৈকত রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। পর্যটন বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের চেয়ে এর গুরুত্ব কোন অংশে কম হবে না। ঢালচরের তারুয়া হতে পারে দেশের তৃতীয় সমুদ্র সৈকত। তবে এখানে পর্যটকদের যাতায়াতের সুযোগ করে দিতে হবে। স্থানটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করা হলে এর উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে।  ঢালচরের মূল ভূ-খণ্ডের পূর্বে পূর্ব ঢালচর নামের ম্যানগ্রোভ বনের গা ঘেঁষে ভাসান চরের নিকটে আরেকটি সমুদ্র সৈকতের সন্ধান মিলেছে। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে সম্প্রতি এ প্রতিবেদক নতুন এ সমুদ্র সৈকতের সন্ধান পান। এ প্রতিবেদক সৈকতটি আবিষ্কার করেছেন বলে তারই নামে স্থানীয় বাসিন্দারা এ সৈকতের নাম রেখেছেন ‘রফিকুল সমুদ্র সৈকত’। প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সমুদ্র সৈকতে শীতের পাখিদের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে। জনমানবহীন এ সৈকতের পাশে বেশ কয়েকটি ম্যানগ্রোভ বন। বনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা খাল।

 

ঢালচরের প্রাণকেন্দ্র হাওলাদার বাজার থেকে ট্রলারে এ সৈকতে যেতে সময় লাগে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি পর্যটকেরা এখানে বনের সৌন্দর্য্যও উপভোগ করতে পারেন। যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলে এখানেও পর্যটকদের ভিড় বাড়বে। শুধু ঢালচর কিংবা কচ্ছপিয়া হয়ে নয়, চরফ্যাশনের সামরাজ থেকে ট্রলার কিংবা অন্য কোনো নৌযানে এই সৈকতে যাতায়াত করা যেতে পারে। ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ঢালচর ঝুঁকির মুখে রয়েছে এটা ঠিক। ভাঙনের কারণে বহু মানুষ আর্থিকভাবে দুরবস্থার মধ্যে আছে। কিন্তু এত সংকটের মাঝেও এখানে যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বহুবার আবেদন-নিবেদন করেছি। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া মিলেনি। তিনি বলেন, ঢালচরের দক্ষিণে সমুদ্র থেকে আরেক বাংলাদেশ জেগে উঠছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব চর জাগিয়ে তুলতে পারলে ঢালচরের চেহারা বদলে যাবে। এর পাশাপাশি সমুদ্র সৈকতের সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাবো। এক ঢালচর থেকেই সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা