পজিটিভ বাংলাদেশ

ডিজিটাল সেবায় ভরসা পাচ্ছেন উপকূলবাসী

গোটা দ্বীপের ভেতরে এক টুকরো আকাশ, যে আকাশের নিচে মেলে তথ্য আর বিনোদনের সুবিধা। বিকল্প বিদ্যুত ব্যবস্থা, ডিশের মাধ্যমে সব টেলিভিশন চ্যানেল দেখা, অনলাইনে সংবাদপত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ- সব সম্ভব এখানে। তাই তথ্যের সন্ধানে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এখানে। জেলে-চাষি-শ্রমিকসহ কর্মজীবীদের ভিড় জমে সন্ধ্যার পর। এটি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের চিত্র। চারদিকে নদীবেষ্টিত এই ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত স্লুইজ বাজার। জায়গাটিকে চরমোন্তাজের ‘রাজধানী’ও বলা যায়। এখানে গড়ে উঠেছে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র, যার সব কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে এখানকার পিছিয়ে থাকা জনপদের অতি সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে। ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই। তথ্যকেন্দ্রে জমেছে অনেক মানুষের ভিড়। জেলে-চাষি থেকে শুরু করে শিক্ষক-ছাত্র সবারই চাই নানা তথ্য। কেন্দ্রের একজন শোনাচ্ছেন অনলাইনের খবর, কাউকে আবার সংবাদের কপি প্রিন্ট করে দেয়া হচ্ছে। দর্শক সারিতে কারও চোখ কম্পিউটারে, কারও বা টিভি স্ক্রিনে। এলাকা ঘুরে এভাবেই ডিজিটাল সেন্টারের কিছু ব্যস্ত সময়ের দৃশ্যপট চোখে পড়ে। সূত্র বলছে, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে; তার ঢেউ লেগেছে উপকূলের দ্বীপাঞ্চলে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দ্বীপের মানুষ সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকছেন কেন্দ্রে। উপকূলের প্রান্তিক ইউনিয়নগুলোতেও ডিজিটাল সেন্টারগুলো মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। দ্বীপের মানুষের অন্ধকারে ডুবে থাকার সেই গল্পের অনেকটা পরিবর্তন এসেছে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাৎক্ষণিক খবর পাওয়ার ফলে তাদের জীবনযাত্রাও বদলে গেছে। ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন কুকরী মুকরীর প্রধান বাজারে প্রায় সন্ধ্যায় টিন পিটিয়ে খবর প্রচার করা হয়। চা-দোকানে বসলে কানে আসে ‘খবর আছে, খবর! কুকরীতে কৃষিব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব আসবেন। যাদের বকেয়া লোন আছে পরিশোধ করিতে পারিবেন। ম্যানেজার সাহেব জাহাঙ্গীরের দোকানে বসিবেন ইনশাআল্লাহ।’ দ্বীপের ‘সাংবাদিক’ মোছলেম উদ্দিন এইসব খবর দেয়। খবর প্রচারকালে তার এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে একটি টিনের খালি জার। লাঠি দিয়ে টিনের ওপর শব্দ করে জোরালে কণ্ঠে নির্দিষ্ট খবর প্রচার করেন তিনি। এভাবে মুহূর্তে যেকোন সংবাদ পৌঁছে যায় ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র পুরান বাজারের সবার কাছে। এলাকার মানুষের গরু-মহিষ কিংবা ছাগল হারানো, ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি-ভিজিএফ বিতরণ, বয়স্ক ভাতা বিতরণ, কৃষি ব্যাংকের ঋণ আদায়, বাগদা চিংড়ির দাম বৃদ্ধিসহ সব খবর প্রচার করেন এই সাংবাদিক। কিন্তু এই চিত্র এখন অনেকটা বদলেছে। মোছলেম উদ্দিন এখনও খবর প্রচার করেন তার পুরনো ভঙ্গিতে। কিন্তু তার আগেই মানুষজন এখন মোবাইলে-ইন্টারনেটে-রেডিওতে খবরগুলো পেয়ে যান। এখানকার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে মানুষজন পাচ্ছেন নানান তথ্যসেবা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে এই দ্বীপ কুকরী মুকরীর ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তথ্যসেবা কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেছিলেন। এই কেন্দ্রটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সারাদেশের চার হাজার ৫০১টি তথ্যসেবা কেন্দ্র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছিল। ইউএনডিপির প্রশাসক ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক এ প্রযুক্তি উদ্বোধনের জন্য কুকরী মুকরী দ্বীপে এসেছিলেন ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর। এখানকার ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্যাটেলাইন ও ইন্টারনেট সেবায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে কথা বলেন হেলেন ক্লার্ক। তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু রাখতে এখানে দেয়া হয় তিনটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকা ভোলার চরফ্যাসনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিচ্ছিন্ন জনপদের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এবং তাৎক্ষণিকভাবে দুর্যোগের খবর জানতে এই তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু হয়। কী পরিবর্তন এসেছে গত ছয় বছরে? এই প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘আমরা ছিলাম এক অন্ধকার যুগে। সন্ধ্যা হতে না হতে এখানে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতো। বাইরের সঙ্গে ছিল না কোনো যোগাযোগ। ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে তখন অনেক বেশি ক্ষতি হতো। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি দ্বীপবাসীকে আলোকিত করেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছে। ঝড়ের বার্তা আমরা এখন সহজেই পাই। দ্বীপের বাইরে থাকা মানুষের সাথেও যোগাযোগ হয় মোবাইলে। মনে হয় তারা কাছেই আছে। ফলে নিজেদের খুব সাহসী মনে হয়।’ তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় ২০১০ সালের পর থেকে দ্বীপ ইউনিয়ন কুকরী মুকরীর জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে জানালেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন। তিনি বলেন, ‘২০১০ সালের কুকরী আর এখনকার কুকরীর মধ্যে অনেক ব্যবধান। ইউনিয়ন পরিষদের সেবার দিক থেকে বললে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে আগে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো; এখন আর সে ভোগান্তি নেই। বিদেশ তো দূরের কথা; জেলা-উপজেলা সদরের সঙ্গেই এখানকার মানুষের যোগাযোগ ছিল দুঃসাধ্য। এখন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নিবন্ধন করে দ্বীপের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পর্যন্ত চাকুরির সুযোগ পাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দ্বীপের মানুষ এক সময় ঢাকা কিংবা বরিশাল থেকে আসা খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করতো। এখন আর অপেক্ষা করতে হয় না। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি হাতের মুঠোয়। দ্বীপের অন্তত ৩ শতাধিক মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে। এর মাধ্যমে দ্বীপের মানুষগুলো কেন্দ্রে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এর পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকাটাও তার জীবনের জন্য অনেকটা অপরিহার্য।’ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে সেবা নিতে আসা লোকজন জানালেন, তথ্য আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জমিতে কৃষিকাজ, সাগর-নদীতে জাল ফেলা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই তথ্যের প্রয়োজন। এছাড়া এখানে পাওয়া যায় নানা ধরনের আইটি সেবা। কম্পিউটার নষ্ট হলে, মোবাইলে সমস্যা দেখা দিলেও এই কেন্দ্র মানুষের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার আগে এসব কাজে মানুষ অনেক সমস্যায় পড়তো। এখন আর সে সমস্যা নেই। তথ্য বিষয়ক কাজের জন্য এখন আর দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা সদরে যেতে হয় না। তথ্য দিয়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র যেন দ্বীপকেই জাগিয়ে রাখেছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষজন এখন কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাছাড়া সাধারণ মানুষ এখান থেকে অল্প খরচে সেবা পাচ্ছে। কেন্দ্রে সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। এই দ্বীপের অন্য কোথাও এমন ব্যবস্থা নেই। এখানে এসে সাধারণ মানুষ স্কাইপির মাধ্যমে বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। অনলাইনে সংবাদপত্র ও টিভি দেখে জানতে পারে সব খবর।’ লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন চর আব্দুলাহ’র বাসিন্দা আলাউদ্দিন মাস্টার বলছিলেন, স্বজনদের কেউ থাকেন দেশে, কেউবা বিদেশে। উপকূলের প্রান্তিক জনপদে থেকে দূর-দূরান্তে অবস্থানকারী এইসব স্বজনের খোঁজ নেওয়াটা একসময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। লেখাপড়া জানা লোকজন কালেভদ্রে চিঠিপত্র লিখলেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেটা পর্যাপ্ত ছিল না। তাৎক্ষণিক যোগাযোগের কোন সুযোগ ছিল না বললেই চলে। টেলিফোনে জরুরি খবরটা জানানোও ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি উপকূলের এই অন্ধকারেও আলো ফেলেছে। দূরে অবস্থান করলেও এখন আর স্বজনেরা দূরে নন। চাইলেই যখন তখন যোগাযোগ করা যায়। শুধু মোবাইলে নয়, উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষেরা দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী স্বজনের সঙ্গে অতি সহজে কথা বলতে পারেন স্কাইপিতে। ফলে দূরে থাকলেও বাড়ির প্রতিটি সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারেন তারা। হাতিয়ার সুখচরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘ছেলে পড়ে থাকে বিদেশে। আর আমি দেশের মাটিতে। ছেলের কোন খোঁজ পেতাম না। বাড়ির কোন বিষয়ে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারতাম না। এখন তো চাইলেই কথা বলতে পারি। ছেলে কেমন আছে জানতে পারি। আমরা এখন একে অপরের কাছাকাছি।’   স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা থেকে বহু দূরের এই এলাকাগুলো সব দিক থেকে পিছিয়ে আছে। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে এখানকার সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তথ্য শূন্যতায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেমে আসতো চরম দুর্ভোগ। দুর্যোগের সিগন্যাল তাদের কাছে পৌঁছাতো না। ফলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেত। কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধা সে অবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মাঝে বেড়েছে সচেতনতা। প্রত্যন্ত জনপদ সংযুক্ত হচ্ছে কেন্দ্রে। কুতুবদিয়ার তাবালর চরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় আমরা অন্ধকারে ছিলাম। ঢাকায় কী হচ্ছে কিছুই জানতে পারতাম না। এখন জানতে পারি। রাজনৈতিক উত্তাপ কিংবা অন্য কোন কারণে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাওয়া খবরেই এখন ভরসা। সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া খবর আমাদের ভাবতে সাহায্য করছে, সিদ্ধান্ত নিতে সুযোগ করে দিচ্ছে।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২০১৮/তারা