পজিটিভ বাংলাদেশ

ঢালচরের বাতিঘর

রফিকুল ইসলাম মন্টু: কোন স্কুলে পড়ো? ঢালচরের শিশু-কিশোরদের কাছে এমন প্রশ্ন করলে সকলেরই সোজা জবাব- ‘আজাহার ছারের স্কুলে পড়ি’। একটু অবাক করা জবাব! প্রশ্ন জাগে, স্কুলের এ আবার কেমন নাম? পরে জানা গেল ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নাম আজাহার উদ্দিন। তিনি শুধু এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নন, আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে ঢালচরে শিক্ষার আলো জ্বলছে তারই হাত ধরে। এই সময় এখানে যত মানুষের লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে; এই মানুষটির কারণেই। সে কারণে তাকেই এখানকার বাসিন্দারা ঢালচরের বাতিঘর বলে চেনেন। নিরিবিলি একজন মানুষ। ভোলার চরফ্যাসনের দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের শরীফপাড়ায় নিজের ঘরে বসবাস। বাড়ির কাছের স্কুলে সারাদিন কাটানো; অবশেষে শেষ বিকেলে হাতে টর্চ লাইট নিয়ে বাজারে একচক্কর ঘুরে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই আবার বাড়ির পথে। ৫৮ বছর বয়সেও বেশ শক্ত-সামর্থ্য এই মানুষটা সারাজীবন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এখনও তার চেষ্টা থামেনি। এখানকার পঞ্চম শ্রেণী পাস ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজের গণ্ডিতে নিয়ে যাওয়া তার স্বপ্ন। ভর দুপুরে সবার প্রিয় শিক্ষক আজাহার উদ্দিনের শরীফ পাড়ার বাসায় পা রাখি। সমতল উঠোন থেকে বেশ উঁচু ভিটিতে সাজানো গোছানো পরিপাটি টিনের ঘর। ঘরে উঠতে ইট-সিমেন্ট গড়া উঁচু সিঁড়ি। চারিদিকে সবুজের ছায়া ঘেরা বাড়ি। ঘরের সামনের বারান্দার এক পাশে টেবিল চেয়ার এবং জানালার লাগোয়া একখানা চৌকি। সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এক শিশু। তার দিকে মুখ করে কৃত্রিম বাতাস বিতরণ করছে সৌরবাতির পাখা। স্যারের জন্য অপেক্ষা। চারিদিকে তাকাই। দরজার সামনে ঝুলছে ফেলনা প্লাস্টিক দিয়ে হাতে বানানো ফুলের ঝাড়। ঘরের সামনের বেড়াটায় কোথাও নীল রঙের টিন আবার কোথাও কোনাকুনি কাঠ লাগানো হয়েছে। গরমে শরীর ভিজে উঠছে। অল্পক্ষণ পরেই চলে এলেন স্যার, যার কাছ থেকে আলো ছড়ানোর গল্প শুনতে এসেছি। আলাপে জানতে পারি, ঢালচরে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন; এমন চিন্তা কখনোই করেননি আজাহার উদ্দিন। তার বাপদাদার ভিটে ছিল ভোলার দৌলতখানের মির্জাকালুতে। সেখানেই থাকতেন তিনি। ১৯৭৬ সালে মির্জাকালু হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢালচরে বড়বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। কিছুদিন থাকার পর ভালো লাগেনি, তাই আবার নিজের বাড়ি ফিরে যান। সেখানে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই থেকে শিক্ষকতা তার নেশায় পরিণত হয়। ঢালচরে তখনও কোন স্কুল হয়নি। এখানকার বাসিন্দারা তাকে ঢালচরে এসে একটি স্কুল খোলার অনুরোধ জানান। আজাহার উদ্দিনের সায় ছিল না তাতে। অবশেষে আজাহার উদ্দিনকে ঢালচরে আনার জন্য এখানকার গণমান্য ব্যক্তিবর্গ একটি স্কুল করে দেন। ১৯৭৮ সালে ভদ্রপাড়ার মসজিদের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই খড়ের স্কুল ঘর। একইসঙ্গে পরিচালিত হতো মক্তব ও স্কুল। কোনো চেয়ার-টেবিল ছিল না। মাটির মেঝেতেই হতো সকল শ্রেণীর পাঠদান। আজাহার উদ্দিন মাঝখানে বসতেন; আর চারিদিকে গোল হয়ে বসতো শিক্ষার্থীরা। সেদিনের সেই ছোট্ট ঘরটাই কালের পরিক্রমায় ঢালচরের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বিদেশি সাহায্যকারী সংস্থা সুইডিশ মিশন এতে সহায়তা যোগায়। আলাপ প্রসঙ্গে আজাহার উদ্দিন বলছিলেন, একই সঙ্গে মক্তব ও স্কুল পরিচালনার দু’বছর পরে ১৯৮০ সালের দিকে সুইডিশ মিশনের প্রতিনিধি দল ঢালচরের শিক্ষা ব্যবস্থার খোঁজ নিতে আসে। তখন তারা ক্ষুদ্র পরিসরে পরিচালিত এই স্কুলটি দেখতে পেয়ে সহায়তা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের সহায়তায় স্থাপিত হয় একটি কমিউনিটি সেন্টার। এরপর থেকে স্কুলের কার্যক্রম সেখানেই চলতে থাকে। তখন ছিল মাত্র ৩৫-৪০ জন শিক্ষার্থী। অনেকের বয়সই ছিল ১৬ থেকে ১৮ বছর। কারণ, এদের কখনোই সময়মত স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবা মায়েদের ইচ্ছা থাকলেও ছিল না কোন স্কুল। আর স্কুলের প্রথম শিক্ষক আজাহার উদ্দিন একাই। এরপরে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসাবে মফিজুল ইসলাম এবং তৃতীয় শিক্ষক হিসাবেও আরেক মফিজুল ইসলাম যোগ দেন। সুইডিশ মিশন শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, কলম এবং ওষুধ সরবরাহ করতো। তখন স্কুল পরিচালনায় গতি ফিরে আসে। শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকে; সেই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয় শিক্ষক সংখ্যা।  

ঢালচরের শিক্ষা প্রসারের প্রতীক আজাহার উদ্দিনের পড়নে নীল পাঞ্চাবি আর সাদা চেক লুঙ্গি; মাথায় সাদা টুপি। এরসঙ্গে মানানসই মুখভর্তি সাদা দাড়ি যেন একজন আদর্শ শিক্ষকের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে। সদা হাস্যোজ্জল এই শিক্ষক বলেন, নদী ভাঙনের কারণে স্কুলের ভিত্তি বারবার নড়চড় হয়েছে। সুইডিশ মিশনের দেয়া কমিউনিটি সেন্টারটিও নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। তবে হাল ছাড়েননি আজাহার উদ্দিন। স্কুলের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা, পাশাপাশি স্কুল পরিচালনার জন্য আজাহার উদ্দিন নিজেকেও তৈরি করে নেন। বিএ পাস ছাড়াও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। ভাঙন কবলিত ঢালচরে স্কুল পরিচালনায় অনেকবার পালাবদল হয়েছে বলে জানালেন আজাহার উদ্দিন। সুইডিশ মিশনের দেয়া কমিউনিটি সেন্টারটি ভাঙনে হারিয়ে যাওয়ার পর স্কুলের জন্য একখণ্ড খাসজমি নেওয়া হয়। সেখানে অ্যাকশন এইডের সহায়তায় ভবন তৈরি হয় ১৯৮৫ সালে। এরপর জাপানী সহায়তায় তিনতলা ভবন নির্মিত হয় ২০০৩ সালে। সরকারের তরফে একটি দোতলা ভবন তৈরি হয় ২০০৭ সালে। সবই হয়েছে স্কুলের মাত্র ৩ একর জমিতে। অনেক চেষ্টার পর শিক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল সেখানে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে যায় ২০১৪ সালে। এর পরপরই বর্তমানের শরীফ পাড়ায় স্থানান্তর করা হয় স্কুলটি। ১৯৯১টি সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর অ্যাকশন এই সাইক্লোন শেল্টারটি নির্মাণ করে। ভবনটি দোতলায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের অফিস। নিচতলা ফাঁকা পড়েছিল। চারিদিকে টিনের বেড়া দিয়ে স্কুল চালানোর উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু এখান থেকেও ভাঙন খুব বেশি দূরে নয়। আলাপে জানতে পারি, ১৯৮১-৮২ সালে পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম ব্যাচ বের হয় আজাহার উদ্দিনের হাত ধরে। ১৯৮৪ সালে প্রাথমিকের সমাপনী পরিক্ষায় মাত্র ৩ জনকে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হয়েছিল এখান থেকে। এই তিনজন শিক্ষার্থী হলেন বর্তমান ঢালচর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার, মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ আলী এবং গ্রাম পুলিশ মো. মোস্তফা। পরবর্তী সময়ে এখানকার অনেকেই আজাহার স্যারের হাত ধরে উচ্চশিক্ষার পথে পা রেখেছেন এবং অনেকে বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশ করেছেন আজাহার স্যারের অনেক ছাত্র। আজাহার উদ্দিনের প্রথম দিককার ছাত্র ঢালচর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আজাহার স্যার এই ঢালচরে না এলে এখানে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে আরও অনেক সময় লাগতো। প্রথম দিকে আমরা অনেক কষ্ট করে খড়ের ঘরে মাটির মেঝেতে পাটি বিছিয়ে স্যারের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছি। সেই সময়ে স্যার ঢালচরে না এলে আমাদেরও লেখাপড়া হতো কিনা সন্দেহ। আমার মত আরও অনেকে স্যারের কাছ থেকেই শিক্ষার আলো পেয়েছেন।’ শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নয়, ঢালচরে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রসারেও অবদান রয়েছে আজাহার উদ্দিনের। তিনি দেখলেন, অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পর মাধ্যমিকে পাঠানোর চিন্তা করে না। কেউ কেউ ওপারে গিয়ে কোনমতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে পারলেও তারপরে আর পড়াশোনা হয় না। আজাহার উদ্দিনের ভাষায়, ‘এইট পাশ করে ছেলেরা একটা বউ নিয়ে ঘরে আসে।’ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরীর সহায়তায় ঢালচরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন করেন। আজাহার উদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ের বাবা। নিজের বাড়ি শরীফ পাড়ায় থাকেন। সারাজীবন শিক্ষার পেছনে ছুটে চলা এই মানুষটি অবসর নেবেন শিগগিরই। ‘কী করবেন অবসরের পর?’ এমন প্রশ্নের জবাবে আজাহার উদ্দিন বলেন, ‘সারাজীবন শিক্ষার পেছনে দিয়েছি। বাকি জীবনও শিক্ষার পেছনেই কাটবে।’ তিনি বলেন, ‘স্কুলই আমার নেশা। স্কুল যেদিন চলে না, সেদিনটি আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে। অতৃপ্তি রয়ে গেছে। আরও অনেক কিছু করতে চেয়েছি। এখানকার ছেলেমেয়েরা যাতে এখানেই মাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজে পড়তে পারে; সে স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানি না।’ ঢালচরের অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে আজাহার উদ্দিন বলেন, ‘এখানে ছেলেমেয়ের স্কুলে যাওয়া নির্ভর করে তাদের ওপর। এজন্য তাদের আরও সচেতন হতে হবে। শিক্ষকেরা বেশি চাপ দিলে অভিভাবকেরা সেটাকে অন্যভাবে নেন। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। সন্তানের শিক্ষার গুরুত্বটা সবার আগে তাদেরকেই বুঝতে হবে।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুন ২০১৮/তারা