পজিটিভ বাংলাদেশ

বগুড়ার দই কেন বিশ্বখ্যাত, জেনে নিন সেই ফর্মুলা

দই মানেই বগুড়া। বগুড়া মানেই দই। দেশের মানুষের কাছে বগুড়া ও দই এভাবেই পরিচিত। এই অঞ্চলের দইয়ের চাহিদা সমানভাবে রয়েছে সারাদেশে। এখানকার ব্যবসায়ীরাও একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও বগুড়ার দইয়ের অনেক বড় মার্কেট রয়েছে। কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর হলে দই নিয়মিত রপ্তানি করা সম্ভব। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বগুড়ার অনেক বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

দইয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলে ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি করেন। তিনি বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় থাকতেন। ঘেটু ঘোষ চিনি, গুড় ছাড়াই দই বানাতেন, তাই এর স্বাদটা ছিল টক। দই তৈরি যেন অন্য কেউ শিখে না ফেলেন, এজন্য ঘোষেরা যখন দারুণভাবে এর গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। তবে এত মজাদার খাবারের ফর্মুলা বেশিদিন তারা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। 

দই তৈরির সূচনা ঘেটু ঘোষ করলেও দইয়ের খ্যাতি এনে দেন গৌর গোপাল। গৌর গোপাল শেরপুর থেকে বগুড়া শহরের বনানী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ভাড় ভর্তি করে দই আনতেন বিক্রির জন্য। দইয়ের সঙ্গে তিনি বানাতেন সরভাজা। এ সরভাজাই গৌর গোপালকে এনে দেয় খ্যাতি। 

এছাড়া তৎকালীন বাংলার ইংরেজ গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসন পর্যন্ত দই খাওয়ার পর এর স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৩৮ সাল। সে সময় তিনি প্রথম দই খাওয়ার পর ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। এছাড়া ষাটের দশকের প্রথমভাগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বগুড়ায় এসে দই খেয়ে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি সে সময়ের ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের কাছে এবং মার্কিন মুল্লুকে বগুড়ার দই উপঢৌকন হিসেবে পাঠান। ব্রিটেনের রানীও সে সময় এ দইয়ের ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। এভাবেই বগুড়ার দইয়ের সুনাম দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় বগুড়ার দই জনপ্রিয়তা পায় ভারতে।

দই তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারিগরদের কাছ থেকে জানা গেছে, দই তৈরি করতে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। প্রথমে কড়াই বা পাতিলে গরুর দুধ, প্রয়োজন মতো চিনি মিশিয়ে চুলায় উঠিয়ে ৫ ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিতে হয়। এ সময়টাতে অনবরত দুধ হাতা দিয়ে নেড়ে দিতে হয়। তা না হলে দুধ জ্বাল দেওয়ার পাত্রে পোঁড়া লেগে যেতে পারে। এভাবে দুধের বর্ণ কিছুটা লালাভ রঙ ধারণ করা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। এরপর একটি চুলায় হালকা আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে মাটির হাঁড়ি বা সরা সাজিয়ে নিয়ে সেগুলোতে জ্বাল দেওয়া দুধগুলো ঢেলে রাখতে হয়। এরপর বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশালাকার ডালা (টিপনি) দিয়ে সেগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়। এই ডালার এক পাশে খুব বড় নয় এমন গোলাকার ছিদ্র করে রাখা হয়, যাতে ভেতরের গরম বাতাস বের হতে পারে। এরপর ৮ ঘণ্টা পর টিপনি তুলে খুব সামান্য দইয়ের বীজ জ্বাল দেওয়া দুধগুলোতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আরও বেশ ক’ঘণ্টা টিপনি দিয়ে ঢেকে রাখার পর দই প্রস্তুত হয়ে যায় খাবারের জন্য। দই তৈরির প্রক্রিয়ার সময় উপরের অংশে সুস্বাদু ঘন জমাট বাঁধা একটি স্তর পড়ে। 

এদিকে, মহরম আলী, আকবরিয়া, চিনিপাতা দইঘর, এশিয়া সুইটমিট, শ্যামলি, রুচিতা, সাউদিয়া, দই বাজার, ফুড ভিলেজসহ অসংখ্য দইয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে বগুড়ায়। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানই দাবি করেন তাদের দই-ই গুণগত মানের দিক থেকে সেরা। যে কারণে বগুড়া শহরেই দইয়ের দাম একেক প্রতিষ্ঠানে একেক রকম। শহরের সাতমাথা বা বাসস্ট্যান্ড এলাকার এসব দোকান থেকে দই কিনতে চাইলে বর্তমান বাজার অনুযায়ী সরার দই ১৬০-২৪০ টাকায় কিনতে হবে। আর হাঁড়ি ৯০ থেকে ১২০ টাকা এবং ছোট কাপ দই ৩৫ টাকায় কিনতে পারবেন। এছাড়া বিভিন্ন হাট-বাজারে খুঁজলে দই এর চেয়েও কম দামে পাওয়া যাবে। তবে ভালো দই খেতে চাইলে অবশ্যই দামটা একটু বেশি গুনতেই হবে।

বগুড়ার চিনিপাতা দইঘরের পরিচালক মুক্তার আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কেউ চাইলেও বগুড়ায় যে দই তৈরি হয়, সেই দই অন্য জেলায় তৈরি করতে পারে না। ইতোপূর্বে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।’ 

তিনি উল্লেখ করেন, ‘বগুড়ার আবহাওয়া, মাটি এবং পানি এই প্রাকৃতিক কারণেই অন্য জেলায় সম্ভব হয় না। তবে অনেক জেলার মানুষ বলে থাকেন, বগুড়ার দই শুধু নামেই চলে। বিষয়টি আসলে তেমন না। আমরা জানি, প্রায় প্রতিটি জেলাতেই অসাধু ব্যবসায়ী নিজেরা দই তৈরি করে বগুড়ার নাম দিয়ে চালায়। যে কারণে এই সমস্যাটার সৃষ্টি হচ্ছে।’ 

আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, ‘দেশের বাইরে বগুড়ার দইয়ের অনেক বড় মার্কেট আছে বলে আমি মনে করি। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোপূর্বে সিঙ্গাপুর, ভারত, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে ফ্রিজিং সিস্টেমে পাঠানো হয়েছে। তবে দইয়ের স্থায়ীত্বকাল ঠিক রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি দই তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। দই রপ্তানিতে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, যেমন- ক্যারিং, বাইরে পাঠানোর জন্য যে সিস্টেমগুলো দরকার, সেই সিস্টেমগুলো ডেভলপ করা এবং আমরা যারা দই উৎপাদন করি, তাদের সরকারি সহযোগিতা দরকার। বিশেষ করে কাস্টমস, ভ্যাট, ট্যাক্স এগুলোকে সহজ করলে রপ্তানি আমাদের জন্যও সহজ হবে।’