পজিটিভ বাংলাদেশ

বারি-১ জাতের কলা চাষে হাজারো কৃষকের ভাগ্যবদল

নরসিংদীতে ঐতিহ্যবাহী কলা ‘অমৃত সাগর’-এর খ্যাতি দেশজুড়ে। এই জাতের কলাসহ আরও উন্নত জাতের কলা চাষে হাজারো কৃষকের ভাগ্য বদল হয়েছে। রোগবালাই কম হওয়ায় সহজে কলা চাষ করা যায়। তাই দিন দিন চাষের প্রতি ঝুঁকছেন স্থানীয় কৃষকরা। 

তবে অমৃত সাগরের জন্য এ জেলা বিখ্যাত হলেও ধীরে ধীরে এ জাতের কলার চাষ কমে যাচ্ছে। অমৃত সাগরের স্থান দখল করে নিচ্ছে বারি-১ (উন্নত) জাতের কলা। ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরাও চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। 

মূলত নদীবেষ্টিত হওয়ায় এ জেলার মাটি পলি ও দোআঁশ যুক্ত। কলার ফলন এ ধরনের মাটিতেই বেশি হয়। এ অঞ্চলের মাটির গুণগত মান ভালো ও কলা চাষের জন্যে উপযোগী। বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে কলা বাগান নষ্ট না হলে কৃষকরা লাভবান হন। 

জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে মনোহরদী, পলাশ, শিবপুর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন অংশে সুস্বাদু ‘অমৃত সাগর’ কলা চাষ হয়। বর্তমানে এ জেলায় কলা চাষ আগের অনুযায়ী অনেকটা কমে গেলেও যতটুকু চাষ হচ্ছে, এ থেকে স্থানীয় ও দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে। স্বাদ, গন্ধ, মান ভালো হওয়ায় দেশে-বিদেশে সব জায়গাই এ এলাকার কলার কদর রয়েছে।

প্রবীণ কলা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নরসিংদীর কলা স্বাদ, গন্ধ, রঙ ও আকারে সুন্দর ছিল বলে বাংলার নবাবরা প্রতিদিনের খাদ্যের তালিকায় কলাকে বেছে নিতেন। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত মোঘল সুবেদার, ইংরেজ লর্ডসহ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকদেরই জন্য এ কলা সরবরাহ করা হতো।

শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরও এই কলা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। বিদেশি বণিকরাও শখ করে নরসিংদীর কলা কিনে নিয়ে যেত। তাছাড়া এখনো দেশের কোনো অনুষ্ঠান বা মিলাত মাহফিলে অতিথিদের আপ্যায়নের তালিকায় এ কলার চাহিদা রয়েছে প্রচুর।  

দেশ-বিদেশে কলার কদরের কারণেই পাটের পরে এ অঞ্চলের মানুষের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল ছিল কলা। তবে কখন থেকে নরসিংদীতে কলার চাষাবাদ শুরু হয়, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

স্থানীয়দের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে এ জেলার ৬টি উপজেলায় কমবেশি ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হতো। তার মধ্যে অন্তত ৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হতো শবরি, চাম্পা, চিনি চাম্পা, অগ্নিসাগর ইত্যাদি কলা। উৎপাদন হতো অন্তত ৮০ টন কলা। ওই সব কলা চাষাবাদে ও ব্যবসার সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এ জেলায় প্রায় লাখ খানের মানুষ জড়িত ছিল।

উৎপাদিত কলা নরসিংদী থেকে রাজধানী ঢাকা ও সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। কলা সরবরাহের জন্য পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশের রেলওয়ের একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছিল কলার গাড়ি।

প্রতিদিন বিকেলে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দৌলতকান্দি, শ্রীনিধি, মেথিকান্দা, খানাবাড়ী, আমিরগঞ্জ, পলাশ উপজেলার জিনারদি, ঘোড়াশাল ইত্যাদি রেলস্টেশনে হাজার হাজার টুকরি কলা জমা হতো। সন্ধ্যার পর গাড়িতে তুলে এসব কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো।

এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেললাইনে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনেই কলার বগি থাকত। পাকা কলার টুকরী নিয়ে প্রতিদিন শত শত হকার বিভিন্ন ট্রেনে বিক্রি করতো।

মূলত কলার বহুবিধ ব্যবহারের জন্যই নরসিংদীর মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে অতি আগ্রহে কলা চাষ করতো। সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হতো মনোহরদী উপজেলায়। সেখানকার কলা বেচাকেনার জন্য কয়েকটি বাজারও রয়েছে। তার মধ্যে চালাকচর, সাগরদী, মনোহরদী ও হাতিরদিয়া অন্যতম। এসব বাজার থেকে ট্রাক ভর্তি করে কলা যেতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

এছাড়াও পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর, গজারিয়া, তালতলী, পারুলিয়া, কালির বাজার, রাবান বাজার, চরনগরদী, নরসিংদী সদরের ভাটপাড়া, শীলমান্দী, শিবপুরের ফতেপুর, সিএন্ডবি, পালপাড়া ইত্যাদি বাজারে প্রতিদিন প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার টন কলা আমদানি হতো আর একইভাবে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো।

এখন নরসিংদীর কলার সেই সুদিন নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, সার কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি, রাসায়নিক সার প্রয়োগে জমির গুণাগুণ মান কিছুটা বিনষ্ট এবং সর্বোপরি সরকারি ঋণ ও পৃষ্ঠপোষণের অভাবে কলা চাষের এরিয়া দিন দিন কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে কলার উৎপাদনও।

বিশেষ করে দেশি জাতের সুস্বাদু, সুগন্ধী অমৃত সাগরের উৎপাদন কমে গেছে। দেশি সাগর কলার স্থান দখল করেছে নেপালী সাগর কলা। কোনো কোনো এলাকায় চাষাবাদ হচ্ছে চাম্পা ও শবরি কলা। কিন্তু চাষিরা কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাচ্ছে না।

সরেজমিনে গিয়ে কয়েকজন কলার চাষির সাথে কথা বলে জানা গেছে, কলা চাষের জন্য যে বেলে দোআঁশ মাটির প্রয়োজন, আগের মতো সেই মাটি এখন আর বেশি নেই। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি শক্ত হয়ে গেছে। এখন দেশি সাগর কলা রোপণ করলে গাছ যেমন বড় হয় না, তেমনি কলার ছড়িতেও কাদি বেশি হয় না। কলাও আকারে বড় হয় কম। এছাড়া কলার ছড়িতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। তাই কৃষকরা বারি-১ (উন্নত) জাতের কলায় চাষ করছেন বেশি বেশি।

নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দি এলাকার কলা চাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে খরচ হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এতে ফলন ভালো হলে বিক্রি আসবে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো।

কলাচাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সারা বছরই কলার চারা রোপণ করা যায়। কলার চারা সাধারণত বছরে তিন মৌসুমে রোপণ করা উত্তম। প্রথম মৌসুম মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ। দ্বিতীয় মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে। তৃতীয় মৌসুম মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর। কলা চাষাবাদ করতে সাত-আটবার চাষ দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয়। তারপর জৈবসার বিঘা প্রতি হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়। অতপর ২২ মিটার দূরত্বে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গর্তে ছয় কেজি গোবর, ৫০০ গ্রাম খৈল, ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম, ১০ গ্রাম জিংক এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। ১৫ দিন পর প্রতিটি গর্তে নির্ধারিত জাতের সতেজ চারা রোপণ করতে হবে। শুকনো মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচের প্রয়োজন হয়। ভালো ফলন পেতে হলে গাছ রোপণের প্রথম অবস্থায় ৫ মাস পর্যন্ত বাগান আগাছামুক্ত রাখা জরুরি বলেও জানান তিনি।

একই এলাকার কলা চাষি সোনা মিয়া বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে কলার চাষ করেছি। এতে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবো। এখানকার সাগর কলার মান ভালো হওয়ায় বিক্রির জন্য কোনো চিন্তা করতে হয় না। পাইকাররা কলার বাগ থেকে কিনে নিয়ে যায়।

নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, এখানকার মাটির মান ভালো, কলা চাষের জন্যে উপযোগী। তবে দেশিজাতের কলা চাষাবাদের এরিয়া কিছুটা সংকুচিত হচ্ছে। এবছর জেলার ২ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমিতে কলা চাষাবাদ হয়েছে। এতে দেশি জাতের সাগর কলা চাষ আগের তুলনায় কম। আবাদকৃত কলার মধ্যে বেশির ভাগই বারি-১ (উন্নত) জাতের সাগর কলা। এরপর রয়েছে চাম্পা, শবরি ও কবরী।