পজিটিভ বাংলাদেশ

একজন বইপ্রেমী মোয়াজ্জেম হোসেন

মোয়াজ্জেম হোসেন। পেশায় একজন শিক্ষক। নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনের সাথেও সম্পৃক্ত। একজন লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, মোটিভেশনাল স্পিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠকও তিনি।

এ শিক্ষাবিদের জন্ম ১৯৭৫ সালে ১৮ এপ্রিল শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের খৈনকুট গ্রামে। তিনি ১৯৯০ সালে খৈনকুট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯২ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৯৪ সালে বিএ এবং ১৯৯৬ সালে ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে ইংরেজি বিভাগে এমএ পাস করেন। সর্বশেষে ২০১৪ সালে তিনি ইংলিশ এ পিএইচডি করেন। তার ৫ ভাইয়ের মধ্যে ৪ জনই নিয়োজিত রয়েছেন শিক্ষকতার পেশায়।

মোয়াজ্জেম হোসেন স্কুল জীবন থেকেই ছিলেন একজন বইপ্রেমী। ১৯৮৫ সালে তিনি যখন খৈনকুট স্কুলের ছাত্র, তখন ওই স্কুলের হাবিবুল্লাহ নামে তার এক ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকের পরামর্শ নেন। এরপর থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির আত্মজীবনী পড়তে শুরু করেন এবং ওই সময় থেকেই বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেন।

বর্তমানে তিনি একজন বইপ্রেমী শিক্ষাবিদ হিসাবে সব মহলে পরিচিত। আর সেই থেকে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন বই পড়া আন্দোলন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানুষকে বই পড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে শহর থেকে গ্রামে ছুটে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হাতে নিজেই পৌঁছে দিচ্ছেন বই।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে নিজের কেনা বিভিন্ন লেখকের বই বিনামূল্যে বিতরণ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এই করোনা সংক্রামণের কারণে সরকারি ঘোষণায় যখন বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর মানুষ রয়েছেন লগডাউনে, ঘরবন্দী। এ সময়টা শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকেন, মানুষ যাতে সহজে জ্ঞানের আলো আহরণ করতে পারেন, তার জন্যে মোয়াজ্জেম হোসেন নিজের টাকায় বই কিনে বিভিন্ন স্থানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীসহ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তার দেওয়া বইটি পাঠকের পড়া শেষ হলে এক সপ্তাহ পর তা ফেরত নিয়ে তাকে অন্য বই দিচ্ছেন।

এভাবে মোয়াজ্জেম হোসেন জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন শহর থেকে গ্রামে এবং এর সাথে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। নিয়মিত ১৬০ জন পাঠক সৃষ্টি করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি নরসিংদী শহরে পাঁচ-ছয়টি সেলুন লাইব্রেরিও গড়ে তোলেন। ওই খানে চুল, দাড়ি কাটতে আসা অপেক্ষমান ব্যক্তিরা তাদের পছন্দের লেখকের বই পড়তে পারছেন।

ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বই পড়ার জন্য বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সচেতন মানুষ নিয়ে নরসিংদীতে মানববন্ধনের আয়োজনও করেন। তাছাড়া তিনি জেলার ১০০টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন-লাইব্রেরি না হোক অন্তত বইভর্তি সেলফ রাখার জন্য। তিনি অসংখ্য শিক্ষার্থীকে তার নিজের লেখা বই উপহার দিয়েছেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ভালো ছাত্র হওয়ার টেকনিক বইটি ৫ হাজার কপি বিতরণ করেছেন।

মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত আয়োজন করে যাচ্ছেন বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক। তার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা। একটি ভালো বই একজন ব্যক্তির পরম বন্ধু। বই মানুষের মনের কষ্ট দূর করে। মনের শক্তি বৃদ্ধি করে। বই পড়ে মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করবে, তা কখনো ছেড়ে যাবে না। 

মোয়াজ্জেম হোসেন এখনো নরসিংদী শহরে ভাড়া বাসায়ই বসবাস করেন। তার জ্ঞান ফেরি করে যাচ্ছেন মানুষের মাঝে। নিজের টাকায় বই কিনে শহর থেকে গ্রামে বই নিয়ে বিলিয়ে বেড়ান। তিনি যেখানে যান সাথে বই তার সঙ্গী হিসাবে থাকেই। তিনি চান হিংসামুক্ত সচেতন সমাজ।

বইয়ের পাঠক বাড়ানো ও বই পড়ার গুরুত্ব তুলে ধরতেই বই পড়া আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন তিনি। এজন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে যাচ্ছেন এই শিক্ষাবিদ। লাইব্রেরির পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট-বড় সবার দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এলাকা হিসেবে খ্যাত নরসিংদী শহরের পশ্চিম ব্রাহ্মন্দীতে অল্প সংখ্যক বই দিয়ে নিজ উদ্যোগে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটি ২০২০ সালে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়। তার এই লাইব্রেরিতে রয়েছে বিভিন্ন দুর্লভ বই।

তার মধ্যে রয়েছে, প্রাচীন পুঁথি, নরসিংদীর প্রাচীন ইতিহাস, ঢাকার ইতিহাস, বিক্রমপুরের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী, মোটিভেশনাল, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ, সম্মাননা, স্মারগ্রন্থ, ইংরেজি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, বাংলা-ইংরেজি অভিধান, বাংলা ইংরেজি ব্যাকরণ, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলন, দুর্লভ ম্যাগাজিন, ইতিহাস ঐতিহ্য, অনুবাদ, ধর্মীয় সংক্রান্তসহ ৫ হাজারের বেশি বই। এছাড়াও লাইব্রেরিতে রয়েছে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা।

বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি বইয়ের জন্যে রয়েছে আলাদা আলাদা সেলফ। এ পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ে জ্ঞানসমৃদ্ধ হচ্ছেন পাঠকেরা। প্রতি শুক্রবার বাদে সপ্তাহে ছয়দিনই খোলা থাকে।

নরসিংদী বিষয়ে কেউ জানতে চাইলে বা গবেষণা করতে চাইলে এ লাইব্রেরির বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠক বিশেষ করে স্থানীয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কবি লেখকরা নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে বেশি আসেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়াও নরসিংদীর পুরাতন টাউন হলের সম্মুখে নরসিংদীর জাদুঘর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ঘরে তুলেছেন। ওই জাদুঘরে রয়েছে, জেলার ইতিহাস ঐতিহ্যর নিদের্শনার প্রতিকৃতি। যা দেখলে যে কেউ অতি সহজে জেলার পরিচিতি ও দিক নিদের্শনার অনুমান করতে পারবেন। তাছাড়াও তার গ্রামের বাড়িতে পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষানুরাগী সামসুদ্দিন নামে আরও একটি পাবলিক লাইব্রেরি, প্রতিষ্ঠা করেন নরসিংদী সাহিত্য একাডেমি, জেলা কবি লেখক পরিষদ, ড. এমএইচ ফাউন্ডেশন ও গ্রিন বাংলাদেশ নামে সংগঠন।

তিনি বেশ কয়েটি প্রকাশনারও সম্পাদন করেন। তার মধ্যে প্রেসিডেন্সি, প্রত্যয়, আড়িয়াল খাঁ, সোনাই মুড়ি, সুবর্ণবিথী (নরসিংদী জেলা ডিরেক্টরি) ও সাগরদি-সরকার আবুল কালাম স্মারক সংখ্যা। অনুবাদ করেন বিদগ্ধ দিনের প্রান্তর,  I am gifted so are you, Weste land By T.S Eliot, My Poetry.

আন্তর্জাতিক জার্নালে এ পর্যন্ত তার ৪টি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। এ কাজের স্বীকৃতি হিসাবে দেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে এপর্যন্ত ১৪টি সম্মননাও পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০১৮ সালে স্বদেশ সাংস্কৃতি ফাউন্ডেশন কর্তৃক অমর একুশে সম্মাননা, একই সালে হিউম্যান রাইটস শাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা শাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড, শেরে বাংলা এ. কে এম ফজলুল হক স্মৃতি পদক এবং ২০১৯ সালে সবুজ আন্দোন কর্তৃক গ্রিনম্যান অ্যাওয়ার্ড ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পদক।

নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক কানিজ ফাতেমা বলেন, লাইব্রেরিতে প্রতিদিন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পাঠক বই পড়তে আসছেন। অনেকে বইয়ের সংগ্রহ দেখে প্রশংসা করেন এবং যে পাঠক একবার এ লাইব্রেরিতে বই পড়তে আসছেন, তিনি পুনরায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন।

নিয়মিত পাঠক কলেজ শিক্ষার্থী তুহিন ভূইয়া বলেন, বই পড়লে একজন মানুষ কখনো খারাপ কোনো কাজের প্রতি আকৃষ্ট হবে না। পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যাস আমার ছিল না, মোয়াজ্জেম স্যারের কথায় বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। তিনি একজন জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। তিনি সবসময়ই জ্ঞানের কথা ও বই পড়ার কথা বলেন, মানুষের দ্বারে বই নিয়ে যান। আমি এ পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ে অনেক কিছু শিক্ষতে এবং জানতে পারছি।

কলেজ শিক্ষার্থী রহমত উল্লাহ বলেন, পাঠক তৈরির পাশাপাশি ভালো মানুষ তৈরির কাজও করেন মোয়াজ্জেম স্যার। আমরা নিয়মিতই স্যারের কাছ থেকে বই নিই। পড়ে আবার ফেরত দিয়ে যাই। এতে বই পড়ে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

নরসিংদী ইনডিপেনডেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধা বলেন, জ্ঞান অর্জন করার কেবল দুটি উপায়, একটি হচ্ছে বই পড়ে আরেকটি হচ্ছে জীবনযাপনকে দেখে অর্থাৎ ভ্রমণ করে। মানুষ বই পড়া থেকে দূরে সরে আসছে। এই মুহূর্তে নানা সীমাবদ্ধতার পরও ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বই পড়া আন্দোলন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

নরসিংদী মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ ও সাবেক মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম শাহজাহান বলেন, নরসিংদীতে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইয়ের পাঠকে জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরি। বইপ্রেমী ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের অদম্য আগ্রহ ও উৎসাহে নরসিংদীতে বই পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। 

ইতোমধ্যে অনেক পাঠক তার গড়া পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত বই পড়তে আগ্রহ হয়ে উঠছেন। তাছাড়া তিনি শুধু লাইব্রেরি করেই ক্ষান্ত হননি, শহর থেকে গ্রামে গ্রামে মানুষের দোরগোড়ায় বই বিতরণ করে পাঠক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটি অত্যন্ত সুন্দর উদ্যোগ বলে আমি মনে করি।