পজিটিভ বাংলাদেশ

শাপলায় ৩০০ পরিবারের জীবিকা 

গাজীপুরের কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার নলগাঁও, প্রহলাদপুর, ডুমনী, লক্ষ্মীপুর, টোকনয়ন বাজার, দুবার্টি, মোহানীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শাপলা বিক্রি করে বছরের কিছু সময় জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষা শুরুর পর শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত ওসব গ্রামের কমপক্ষে ৩০০ পরিবার শাপলা বিক্রি করে। বিল থেকে সংগ্রহ করেন পরিবারের পুরুষেরা আর প্রক্রিয়াজাতের সিংহভাগ কাজ করেন নারীরা।

সাদা শাপলা স্থানীয় বাজারগুলোতে সবজি হিসেবে বেচা-কেনা হয়। আর লাল শাপলা বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকার বিভিন্ন ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়।

এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির পাশে বাঁশের আড়ায় কাঁচা শাপলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কুচি কুচি করে কাটা শাপলা গ্রামীণ সড়ক আবার বাড়ির উঠানে রোদে শোকাতে দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া করা শুকনো শাপলাগুলো বড় ব্যাগে ভর্তি করে বসতঘরে স্তুপ করে রাখা হয়েছে।

শ্রীপুর লগোয়া গাজীপুর সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের গৃহিণী অঞ্জনা দাস জানান, পুঁজি বলতে ৪ হাজার টাকায় একটি নৌকা কিনেছেন। শাপলা তুলে বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। দুটি ছেলের পড়াশোনার খরচসহ সংসারের অন্য খরচও মেটাতে পারেন শাপলা বিক্রির টাকায়। 

একই গ্রামের গৃহিণী দিপালী রানী জানান, নৌকা দিয়ে নদী থেকে শাপলা তুলে এনে কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারেন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বা পচে গেলে দাম কম পান।

গৃহিণী আশানন্দ রানী বলেন, নিজস্ব নৌকা না থাকলে বিল থেকে শাপলা উঠাতে গেলে দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকা, গা চুলকানিসহ নানা ধরনের সমস্যা হয়। একটা করে বাছাই করে তুলতে হয়। বৃষ্টি হলে পচে যায়। সব এলাকায় শাপলা থাকে না। তাদের এলাকায় আছে বলে তারা সৌভাগ্যবান। এখন অনেকেই এ ফুল তুলেন। গত বছর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে ১৬০ কেজি বিক্রি করেছেন।

একই গ্রামের গৃহিণী রীনা রানী জানান, তার ছেলে-স্বামী ভোর থেকেই বিলে শাপলা উঠানোর কাজ শুরু করেন। একটা নৌকা পর্যায়ক্রমে একাধিক পরিবার ব্যবহার করেন। শুকনো শাপলা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজিদরে বিক্রি করেছেন। গত ১০ বছর যাবত তারা শাপালা বিক্রি করে আসছেন। তবে তাদের বিক্রিতে বাজারমুল্য সঠিক পান কিনা সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। এলাকায় উঁচু মাঠ-ঘাট না থাকায় রাস্তায় রোদে আবার বাঁশ বেঁধে তার ওপর আঁটি বানিয়ে ঝুলিয়ে রোদে শোকাতে দেন। একজন নারী প্রতি মৌসুমে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। ময়লা ফুলের দাম কম। সক্ষমতা অনুযায়ী ৫ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেন। বিলের জায়গা মালিকানা থাকলেও কেউ শাপলা উঠাতে বাধা দেন না।

শ্রীপুরের নলগাঁও গ্রামের গৃহিণী শেফালী রানী বলেন, কমপক্ষে চার মাস পর্যন্ত শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে শাপলা কেটে রোদে শোকাতে বিক্রিযোগ্য করতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। বিলে পানি থাকে যতদিন, শাপলা পাওয়া যায় ততদিন।

একই উপজেলার প্রহলাদপুরের কৃষক লিটন দাস বলেন, গত ১০ বছর যাবত এসব এলাকায় লাল শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রি করা হচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন ব্যক্তি একসাথে অনেক শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন, যেগুলো শোকানোর পর কমপক্ষে পাঁচ কেজি হয়। সাধারণত পুরুষেরা শাপলা সংগ্রহ করেন। শোকানোর প্রক্রিয়া করেন নারীরা। মাস দেড়েক পর পর ঢাকা থেকে লোকজন এসে ট্রাকযোগে শুকনো শাপলাগুলো নিয়ে যায়। বর্তমানে শাপলা ফুলের বাজারমুল্য বেশি হওয়ায় এলাকার প্রায় সকলেই শাপলা সংগ্রহের কাজ করেন। কমপক্ষে ১’শ টাকা কেজিদরে বিক্রি করা যায়।

গাজীপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রীপুর উপজেলার ফাউগান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লোকনাথ মন্ডল ও তার ভাই রৌদ্র মন্ডল জানায়, ছৈত্যের ডোপ বিলে লাল-সাদা-নীল শাপলা হয়। সাদা শাপলা খাওয়ার জন্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। মনসা পূজায়ও সাদা শাপলা ব্যবহার করা হয়।

চতর বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুল কাদির (৫৬) জানান, এক কেজির আঁটি সাদা শাপলা প্রতি মুড়ি (আঁটি) ৭ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করেন। একদিন পর পর স্থানীয়রা শাপলা তুলে বাজারে নিয়ে আসেন।

ক্ষেত্র মোহন মন্ডল (৯০) বলেন, আমিই প্রথম শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রি শুরু করি। শুকনা শাপলা পাইকাররা ওষুধ বানানোর জন্য বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান। ১ মণ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করি। বারো পাইয়া বিল, পারুলী নদীর চারপাশ থেকে স্থানীয়রা শাপলা তোলেন।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার এএসএম মূয়ীদুল হাসান বলেন, জাতীয় ফুল শাপলা পারুলী নদী ও পাশের বিলগুলোতে বর্ষকালে প্রচুর ফোটে। গত প্রায় ১০ বছর যাবত এলাকাগুলোর শত শত পরিবার শাপলা ফুল সংগ্রহের কাজ করছেন। ওষুধি উপাদান হিসেবে শাপলা ব্যহার হওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। শাপলা সংগ্রহকারীরা ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে বিক্রি করেন। সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি শাপলা এখন ফুলের বিপরীতে জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর সাথে জড়িতরা কৃষিতে নতুন একটা দিগন্ত সৃষ্টি করার মতো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।