পজিটিভ বাংলাদেশ

খরচ কম, ফলন বেশি, মাল্টা চাষে ঝুঁকছে চাষি

নরসিংদীর কাপড় আর সবজির খ্যাতি দেশজুড়ে। কিন্তু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও নরসিংদীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘কলম্বো’ জাতের সুগন্ধি লেবু। এবার বারি মাল্টা-১ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। ফলে অনেক চাষি ভাগ্য বদলের স্বপ্নও দেখছেন।

রসালো ফলের মধ্যে মাল্টা অন্যতম। ভিটামিন ‘সি’সমৃদ্ধ এ ফল। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাল্টার আবাদ। চাষিদের মধ্যে উৎসাহের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বাগানের সংখ্যাও।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট শিবপুরের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে বারি মাল্টা-১ জাতের চারা এনে তারা এর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। প্রায় আড়াই বছর নানা পরিচর্যা ও গবেষণার পর প্রচুর ফলন এসেছে গাছগুলোতে। এই জাতের মাল্টার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী জাত না থাকায় ফলটির আশানুরূপ উৎপাদন হয় না। তবে পাহাড়ি এলাকা হিসেবে পরিচিত শিবপুর অঞ্চলে উষ্ণ জলবায়ু, মাটি উর্বর ও ক্ষারীয় হওয়ায় ফলনও ভালো হয়। এ লক্ষ্যে ২০১৩ সালে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়। ফলে ২০১৬ থেকে প্রথম মাল্টা আবাদ শুরু হয়েছে। এই এলাকায় বারি মাল্টা-১ চাষ সম্প্রসারণে চাষিদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। অল্প খরচ ও পরিশ্রম কম হওয়ায় ফলটি অত্যন্ত লাভজনক।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, সাইট্রাস ফসলের মধ্যে মাল্টা অন্যতম জনপ্রিয় ফল। বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত সাইট্রাস ফসলের দুই তৃতীয়াংশ হলো মাল্টা। ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীন মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল। তবে বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও উষ্ণমন্ডলীয় এলাকায় বেশি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে এই ফলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন এর চাষ বেড়ে চলছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকার ফলটি বর্তমানে নরসিংদী লাল মাটি এলাকায় সহজেই চাষ করা যাচ্ছে। এখানকার কৃষকরা মাল্টা চাষ করে সফল হচ্ছেন। এই এলাকার মাল্টা মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে, দেখতেও সুন্দর।

প্রতি বিঘা জমিতে ১০০ থেকে ১২০টি মাল্টা চারা রোপণ করে একটানা ২০ বছর ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতিটা গাছ থেকে প্রথম বছর ১০ থেকে ২০ কেজি হারে ফল পাওয়া যায় এবং দ্বিতীয় বছর থেকে গড়ে এক মণের বেশি ফল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত চারা রোপণের দুই বছর পর গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। বারি মাল্টা-১ উচ্চ ফলনশীল ও নিয়মিত ফলদানকারী ভিটামিন সি’সমৃদ্ধ। পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় সবুজ এবং খেতে সুস্বাদু।

মধ্য ফাল্গুন মাস থেকে মধ্য চৈত্র পর্যন্ত সময়ে মাল্টা গাছে ফুল আসে এবং কার্তিক মাসে ফল আহরণের উপযোগী হয়। মাল্টা চাষে অল্প খরচ,কিন্তু লাভ অনেক বেশি। তাই একদিকে যেমন এ ফলের আমদানি কমবে, তেমনি মিটবে স্থানীয় চাহিদা। আর স্থানীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হবে।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ৫৩ হেক্টর জমিতে মাল্টার আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে শিবপুর, রায়পুরা, বেলাবো ও মনোহরদী এই চার উপজেলায় মাল্টার ভালো ফলন পাচ্ছে চাষিরা। আগামীতে মাল্টা চাষের আরও পরিধি বাড়াতে উপজেলা কৃষি অফিস ও নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস মনিটরিং ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন মাল্টা চাষিদের।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের শ্রীফুলিয়া গ্রামের কৃষক সৈয়দ আতিকুল রহমানের বাগানে একশ গাছে থোকায় থোকায় ঝুঁলছে মাল্টা। কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, দীর্ঘ ১৭ বছর সৌদি আরবে ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রবাস থেকে দেশে এসে বেকার হয়ে পড়েন। তখন তিনি নিজের জমিতে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৪০ শতক জমিতে ১০০ মাল্টার চারা রোপণ করেন এ থেকে ৮০টি চারা হয়েছে।

২০১৮ সালের শেষ দিকে প্রথম বছরে অল্প ফলন আসলেও বর্তমানে প্রতিটি মাল্টা গাছে ২৫০ থেকে ৩০০টি করে মাল্টার ফলন ধরেছে। বাগানের মাল্টার উপযোগী ফলন আনতে প্রতিটি গাছের পেছনে দিয়েছেন বাড়তি পরিচর্যা। বাগান করতে খরচ হয়েছে তার প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এই বছর ইতোমধ্যে তার এ বাগান থেকে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকার মাল্টা বিক্রিও করেছেন এবং আরও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া তিনি মাল্টার পাশাপাশি এ বাগানে সাথী ফসল হিসাবে পেঁপে চাষও করেন। এ পেঁপে চাষে তিনি এ বছর ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। এদিকে তার এই বাগান দেখে স্থানীয় অনেক কৃষক মাল্টা চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বলে জানান তিনি।

একই এলাকার মাল্টা চাষি ফোরকান আহমেদ বলেন, একসময় বেকার ছিলাম, সবার দেখা-দেখি আমি আমার বাড়িতে মাল্টা চাষ করেছি, মাল্টা চাষ করে অনেক লাভবান ও স্বাবলম্বী হচ্ছি। যদি আমার মতো আশেপাশে যারা বেকার রয়েছে তারা সবাই যদি অল্প অল্প করে মাল্টা চাষ করে, তাহলে আমাদের দেশে যে বেকারত্ব রয়েছে, তা একটু হলেও ঘুচবে। সবাই যদি মাল্টা চাষের প্রতি আগ্রহী হই, তাহলে বিদেশি মাল্টা আর আমদানি করতে হবে না, আমাদের দেশের সবুজ মাল্টা দিয়ে একদিন চাহিদা মেটাতে পারবে।

একই উপজেলার বিরাজ নগর গ্রামের মাল্টা চাষি নিলুফা ইয়াছমিন জানান, ২০০৪ সালে হঠাৎ পানিতে ডুবে তার স্বামী মারা যান। এরপরে তিনি তার দুই সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে বাড়ির পাশে ৪০ শতাংশ জায়গায় কৃষি কাজ শুরু করেন। পরে এ জায়গাতেই তিনি ২০১৭ সাল থেকে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শক্রমে মাল্টা চাষ করেন। ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাথী ফসল হিসেবে আদা চাষও করেন। এখন এ বাগানের আয় দিয়ে তিনি সংসার চালাচ্ছেন। তার বাগানে ফলন ভালো হওয়ায় ৫ থেকে ৬টা মাল্টাই এক কেজি হচ্ছে। একটা গাছে ২৫০ থেকে ৩০০ মাল্টা আসছে। এই ফল ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন। তার বাগানের মাল্টা নিয়ে বাজারে যেতে হচ্ছে না। বেপারীরা বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

জয়মঙ্গল গ্রামের মাল্টা চাষি সুলতান মিয়া বলেন, স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ২০১৭ সালে ৪০ শতাংশে জমিতে মাল্টা চাষ শুরু করি। এতে সব মিলিয়ে খরচ পরেছে ৪৫ হাজার টাকা। ২০২০ সাল থেকে মাল্টা বিক্রি শুরু করেছি। প্রথমে ১০ হাজার টাকা মাল্টা ফল বিক্রি করেও ২০২১ সালে বাগান থেকে মাল্টা বিক্রি করি ৫০ হাজার টাকা। তবে এ বছর আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।

তিনি বলেন, হলুদ মাল্টা বিদেশি ফল। এই মাল্টায় বিষাক্ত ঔষধ দেওয়া হয়। আমাদের দেশের সবুজ মাল্টা যখন খাওয়ার উপযুক্ত হয়, তখন আমরা কোনো বিষাক্ত ওষুধ দেই না। এজন্য সবুজ মাল্টার খুব চাহিদা। নরসিংদীর আশেপাশে জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে পাইকাররা বাগানে এসে ফল কিনে নেয়। এই মাল্টা সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় চাহিদা অনেক ভালো এবং পরিশ্রম কম, অল্প খরচ হওয়ায় আমরা খুব লাভবান। এই মিলে যদি বাগানে ফলন আসে, তাহলে আগামীতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যাবে।

বাঘাব ইউনিয়নের কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা জোসনা বেগম বলেন, শিবপুরের লালমাটি অধ্যুষিত এলাকা মাল্টা চাষের জন্য উপযোগী। আমরা কৃষকদের বিনামূল্যে মাল্টার চারা, স্প্রে মেশিনসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করে মাল্টাচাষ পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে আসছি। এতে দিন দিন কৃষকের পাশাপাশি স্থানীয় বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রশিদ বলেন, নরসিংদীতে এই মৌসুমে ৫৩ হেক্টর জমিতে বারি-১ জাতের মাল্টা চাষ করা হয়েছে। শিবপুর, রায়পুরা, বেলাবো ও মনোহরদী এই চার উপজেলায় মাল্টার ভালো ফলন পাচ্ছে চাষিরা। ভিয়েতনাম জাতের মাল্টা সারাবছর ফলন আসে, সেটা আমরা অনেক বাগানে রোপণ করতে দিয়েছি। যাতে সারাবছর উৎপাদন হয়। আর এই মাল্টা উৎপাদন হলে বিদেশ থেকে যে কোটি টাকার মাল্টা আমদানি করতে হয়, সে আমদানি নির্ভর কমে আসবে। এছাড়া প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১২ মেট্রিক টন ফল ওঠার আশা রাখছে কৃষিবিভাগ।