পজিটিভ বাংলাদেশ

স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে মেহেরপুরবাসীর

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর প্রায় ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পলাশীর আম্রকাননের অদূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়। 

প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার জন্য মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল সেই সময়ের ভীত রচিত হয়েছিল এই জনপদ থেকেই। তাই স্বাধীনতার সূতিকাগার মুজিবনগর তথা মেহেরপুর জেলাবাসীর চাওয়া-পাওয়ার তালিকাটাও দীর্ঘ। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস খ্যাত এই মুজিবনগরকে নিয়ে যে মহা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তার অধিকাংশ এখন বাস্তবায়নের পথে। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উন্নয়নের দাবি-দাওয়ার দরকার নাই। এখানে কিভাবে উন্নয়ন করতে হবে তা আমরাই করবো। সেদিন প্রধানমন্ত্রী মুজিবনগরে স্থলবন্দর, দর্শনা থেকে মুজিবনগর রেলপথ, আমঝুপি থেকে মুজিবনগর কেদারগঞ্জ বাইপাস সড়ক নির্মাণ, মেহেরপুরের মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণ এবং ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, ভৈরব ও কাজলাসহ এ জেলার সব নদ-নদী খনন, মেহেরপুর সরকারি কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু ও পাঁচতলা ছাত্রী নিবাস তৈরি, মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজে পাঁচটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু, মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজকে জাতীয়করণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মুজিবনগর প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই এখন বাস্তবায়নের পথে।

হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রথম মুজিবনগরকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২৩ স্তম্ভবিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি কমপ্লেক্সের কাজ শুরু করে। মেহেরপুর তথা মুজিবনগরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই স্থানটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে, একটি স্থলবন্দর ও মুজিবনগর স্বরস্বতী খালের পূণঃখননসহ এখানে বাংলাদেশের একটি মিনি সংসদ ভবন নির্মাণ এবং বছরে কমপক্ষে একটি সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। 

দীর্ঘদিন পর হলেও মুজিবনগরের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বর্তমান সরকার। নির্মাণ করা হবে একটি আধুনিক মানের পর্যটন কেন্দ্র, দৃষ্টিনন্দন লেক, একটি মিনি পার্ক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মিউজিয়াম, সিনেপ্লেক্সসহ আরও অনেক কার্যক্রম। এরই মধ্যে সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।  কিন্তু এখনো কাজ শুরু হয়নি।

১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি কমপ্লেক্সের অদূরে যে সড়ক দিয়েই ভারত থেকে মুজিবনগরে এসেছিলেন জাতীয় চার নেতাসহ ভারতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। শপথ নিয়ে দেশের প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন, সেই পথটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই সড়কটি (ভার্চুয়ালের মাধ্যমে) ‘স্বাধীনতা সড়ক’ নামে উদ্বোধন করেন। এরই মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সড়কে বাংলাদেশের অংশে ৫০০ মিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। বাস্তবায়ন করা হবে চেকপোস্ট। অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩০ একর জমি। ফলে দু’দেশের মধ্যে বাড়বে ভাতৃত্ববোধ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রেল সংযোগের। এবার সেই দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে মেহেরপুরবাসীর। এরই মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য রেল পরিবহন উইং ভৌত অবকাঠামো বিভাগের পরিকল্পনা কমিশন থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। রেল চলবে দর্শনা থেকে মুজিবনগর হয়ে মেহেরপুর পর্যন্ত।

নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে নৌবাহিনীর অধীনে ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কাস লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ভৈরব নদের ২৯ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু করা হয়। ব্যয় ধরা হয় ৭১ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ২১৬ টাকা। ২০১৬ সালে শেষ হয় নদী খননের কাজ। এর সুফল পাচ্ছেন এলাকাবাসী। ভৈরব নদ খননের বাকি অংশ অচিরেই আবার শুরু হবে।

মেহেরপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ১০০ শয্যার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং গাংনী ও মুজিবনগর স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় রূপান্তর করা। একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এরই মধ্যে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ করা হয়েছে কিন্তু জনবল বাড়ানো হয়নি। এদিকে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির জন্য ২৫০ শয্যা মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের ১১ তলা ভবনের অনুমোদন পায়, যার চারতলা কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলমান রয়েছে কার্যক্রম। গাংনী ও মুজিবনগর স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় রূপান্তর করা হয়েছে। বাস্তবায়নে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে নার্সিং কলেজের কাজ।

দাবি ছিল মেহেরপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে। ২০২০ সালে মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামে মেহেরপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি শিক্ষা খাতে মেহেরপুরবাসীর জন্য একটি মাইলফলক। বাস্তবায়ন হলে এই এলাকার শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। 

মেহেরপুরের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নীতকরণে ৪ লেন রাস্তাসহ রাস্তার সম্প্রসারণের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। চলতি বছরের পহেলা জুন মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্ত ও মান উন্নয়নে ৬৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে মেহেরপুরের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় কৃষিতে যেমন ব্যাপক ভূমিকা রাখবে, সেইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ঘটবে, গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা।

জেলা শহরের উপকণ্ঠে বিজিবি ব্যাটালিয়ন বসাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের উত্তর পাশে সিংএর মাঠে ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ বেতাবের একটি এফএম রেড়িও সেন্টার স্থাপন করতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দক্ষিণ পাশে চাঁদবিল নামক স্থানে সম্ভব্যতা যাচাই শেষে দেড় একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।

মেহেরপুর বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান দিপু ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খোকন যৌথভাবে বলেন, আমরা মুজিবনগর তথা মেহেরপুরবাসী দীর্ঘদিন উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আমাদের এখানে বড় ধরনের কোনো শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি। এখন জেলাব্যাপী যে সব উন্নয়নমূলক কাজ চলছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। জেলায় চেকপোস্ট বাস্তবায়ন হলে ভারত এবং বাংলাদেশের সাথে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে, সেইসঙ্গে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। 

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক অ্যাড. ইব্রাহীম শাহিন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বর্তমান সরকার মেহেরপুরকে গুরুত্ব দিয়ে একজন মন্ত্রী দিয়েছেন। মেহেরপুরবাসী মন্ত্রীত্বের স্বাদ পেয়েছেন। এ পর্যন্ত যেসব উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি, তা এই ৫ বছরে হয়েছে। আমাদের চাওয়া-পাওয়া আরও বেড়ে গেছে। 

জেলা প্রশাসক মনসুর আলম খান বলেন, মেহেরপুরে এরই মধ্যে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও যেসমস্ত কাজ চলমান রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের পথে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এই জেলার মানুষ সুফল ভোগ করতে পারবে। জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, মেহেরপুরকে আধুনিক জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এখন মানুষ নিরাপদে ও স্বস্তিতে বসবাস করছে। যেসব স্কুল-কলেজের ভবন ছিল না, সেসব স্কুল-কলেজে নতুন ভবন দেওয়া হয়েছে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদী খননের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মুজিবনগরকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। এখানে চেকপোস্টের কাজ চলমান রয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওয়াতায় আনা হয়েছে মেহেরপুরকে। 

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সবজি উৎপাদন খ্যাত মেহেরপুর জেলায় আমরা একটি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র করতে চেয়েছি এবং বারাদী কৃষি খামারে জায়গার ব্যবস্থা হয়েছে, যেখানে ৫৭ জন কৃষি গবেষণা কর্মকর্তা বসবেন। এ সরকারের আমলে গাংনীর ভাটপাড়াতে ইকোপার্ক হয়েছে। মেহেরপুরের আমঝুপিতেও ইকোপার্ক করা হচ্ছে, যার অংশ হিসেবে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর উদ্বোধন করা হলো। একই স্থানে একটি শিশুপার্ক করা হবে। এই ৫ বছরে মেহেরপুরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যেটি অন্য কোনো সময় হয়নি। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে।