পজিটিভ বাংলাদেশ

চাকরি ছেড়ে মুক্তা উৎপাদনে ভাগ্য বদল  

নাজিম উদ্দিন। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সদরপুর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় ছিলেন একজন এনজিও কর্মী। এনজিওতে কাজ করার সময় পরিচয় হয় ময়মনসিংহের কয়েকজন ঝিনুক চাষির সঙ্গে। তাদের চাষ দেখে আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় নিজের ৪০ শতাংশ জায়গার পুকুরে ৫০০ ঝিনুক দিয়ে মুক্তা চাষ শুরু করেন। 

নাজিম বছর শেষে দেখেন অধিকাংশ ঝিনুক মারা গেছে। হতাশ না হয়ে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার শুরু করলে সফল হন। আয় হয় ৭০ হাজার টাকা। এরপর থেকে তার আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তিনি এখন সফল ঝিনুক চাষি। সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারের পাশাপাশি ভারতেও বিক্রি করছেন তার উৎপাদিত মুক্তা। খামারে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছেন তিনি।

২০১৭ সালে শখের বশে নিজের পুকুরে মাছের পাশাপাশি ৭ হাজার টাকা খরচ করে ঝিনুক দিয়ে চাষ শুরু করেছিলেন। শুরুতেই অধিকাংশ ঝিনুক মারা যায়। এরপর ২০১৮ সালে ময়মংসিংহ মুক্তা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অরুণ চন্দ্র বর্মণের কাছে গিয়ে আবারও প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝিনুক চাষের কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। ২০১৯ সালে হাওরসহ বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে ৮০০ ঝিনুক দিয়ে চাষ শুরু করে সফল হন। এরপর থেকে আগ্রহ বেড়ে যায় নাজিম উদ্দিনের। 

তিনি বাণিজ্যিকভাবে নেমেছেন মুক্তা উৎপাদনে। ২০২০ সালে মুক্তা উৎপাদন করে কিছু লাভবান হলেও অধিকাংশ মুক্তা মহামারি করোনার কারণে বিক্রি করতে পারেননি। ২০২১ সালে সাড়ে ৩ হাজার ঝিনুক দিয়ে চাষ করেছেন। এবার ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা বিক্রি করার আশা করছেন তিনি। এদিকে কয়েকজনকে চাকরিও দিয়েছেন তার খামারে। তারাও ঝিনুক চাষের পুরো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা চাষ করছেন। পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছেন। সহায়তা পেলে এই মুক্তা দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করছেন নাজিম উদ্দিন।

মহাময়া সুত্রধর, জাকারিয়াসহ অনেকে জানান, তারা বেকার ছিলেন। নাজিম উদ্দিনের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই খামারে কাজ করছেন। তাদের বেকারত্ব দূর হয়েছে। ভালো টাকা বেতনও পাচ্ছেন। এমন অনেকে এই খামারে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। তাদের দাবি, সরকার মুক্তা উৎপাদনে গুরুত্ব দিলে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

খামারের কর্মচারী সুত্রধর বলেন, আমরা ঝিনুকের খোলসের ভেতরের শিরা কেটে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় মুক্তা তৈরির জন্য সেটিং করি। ইমেইজ মুক্তায় দুদিকে দুটি নকশা ঢুকিয়ে রাখতে হয়। পরে ছিদ্র দুইটি কেটে মেডিসিন দিতে হয়। এছাড়া ঝিনুকের ভেতরের দুদিকে দুইটা মনি ঢুকিয়ে দুটি পুতি দিতে হয়। এরপর এক সপ্তাহ ড্রাম বা নেটের জালে রেখে দেখভাল করার পর ঝিনুক ভালো যেগুলো সেগুলোকে দিয়ে মুক্তা উৎপাদন করি। একটি ঝিনুকে ২ থেকে ৩টি মুক্তা জন্ম নিতে পারে।  প্রায় ১০ মাস পর প্রতিটি ঝিনুক থেকে পরিপূর্ণ মুক্তা পাওয়া যায়। মুক্তার দুটি ধরন রয়েছে। একটি রাইস মুক্তা আরেকটি ইমেইজ মুক্তা। ইমেইজ মুক্তার চাহিদা বেশি।

মুক্তা উৎপাদনকারী নাজিম উদ্দিন বলেন, মাছের পাশাপাশি ঝিনুক চাষ শুরু করি শখের বসে। আমাদের এখানে ঝিনুক কিনতে হয় না। হাওরসহ নদ-নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে অপারেশনের মাধ্যমে মুক্তা উৎপাদন করতে হয়। প্রথমে লোকসান হলেও এখন লাভ করছি। বাংলাদেশের জুয়েলারির দোকান ছাড়া মুক্তা বিক্রি করা যায় না। সরকারি চাকরিজীবী, এনজিও কর্মী, ইউনিসেফ প্রতিনিধিসহ অনেকে আমার কাছ থেকে মুক্তা কিনে নেন এবং এখান থেকে দেশের পাশাপাশি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুক্তা বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সহায়তা পেলে এই মুক্তা দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। দূর হবে হাওরাঞ্চলের বেকার সমস্যা। 

ইতোমধ্যে এলাকার ৬ জনকে আমার খামারে চাকরি দিয়েছি। অনেককে মাছ ও মুক্তা উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছি। হাওরাঞ্চলে ঝিনুক চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার আশা আগামী বছর আমি ২২ বিঘা জায়গায় ঝিনুক চাষ করবো, বলেন তিনি।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঝিনুক চাষ মাছ চাষের মতো না। এটায় কারিগরি প্রশিক্ষণ থাকতে হয়। নাজিম উদ্দিন মুক্তা উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে চাষ করছেন। আমরা তাকে আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে থাকি। প্রথম দুই বছর তিনি অনেক কষ্ট করেছেন, লাভের মুখ দেখতে পারেননি। কিন্তু বর্তমানে তিনি মুক্তা উৎপাদন করে সফল হয়েছেন। 

তিনি আরও বলেন, গত বছর তিনি মুক্তা উৎপাদন করে ১ লাখ টাকা লাভ করেছেন। এবার ঝিনুক বেশি মারা যায়নি, তাই অনেক লাভবান হবেন বলে জানিয়েছেন। নাজিম উদ্দিনের মুক্তা সিলেট-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকেন। আগামীতে আরও বেশি জায়গায় ঝিনুক চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন এই চাষি।