পজিটিভ বাংলাদেশ

ঘরের দেওয়াল ভেঙে বাইরে আনা হলো স্পোর্টস কার

ইতালিয়ান ব্র্যান্ড ল্যাম্বরগিনির অত্যাধুনিক মডেলের স্পোর্টস কারের আদলে গাড়ি তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বগুড়ার অজোপাড়া গায়ের ছেলে আব্দুর রহমান রিশান। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ বর্তমানে পড়াশোনা করছেন বগুড়ার একটি কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজে। 

দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া রিশান দাবি করছেন, এই গাড়িটি বানানোর পেছনে তার কোন গুরু নেই বা ইউটিউব থেকেও কোনো সহযোগিতা নেননি তিনি। তবে গুগল থেকে ছবি দেখে ল্যাম্বরগিনি’র এসভি এবং এসভিজে মডেল দুটোর সমন্বয়ে গাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। ফলে গাড়িকে সামনে থেকে দেখলে মনে হবে ল্যাম্বরগিনি’র এসভি মডেলের আর পেছন থেকে দেখলে মনে হবে এসভিজে। 

রিশানের তৈরিকৃত গাড়িটি লম্বায় সাড়ে ১১ ফুট, প্রস্থে ৫ ফুট এবং উচ্চতায় সাড়ে ৩ ফুট। 

রিশান নিজের তৈরি গাড়িটির নাম রেখেছেন ‘লাভার প্রেস’। এত অল্প বয়সে এতো চমৎকার একটি গাড়ি তৈরি করায় অবাক গ্রামের সবাই। তাই প্রতিদিন গাড়িটি দেখতে লোকজন ভীড় করছে তার বাড়িতে।

রিশানের বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পাকুল্লা ইউনিয়নের পদ্মপাড়া উত্তরপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম ইউনুস মিয়া। রিশান সুখানপুকুর সৈয়দ আহমেদ কলেজের বিএম শাখায় দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছেন উদ্যোক্তা উন্নয়ন ট্রেডে।

রিশান জানান, ছোট থেকেই ইলেকট্রিক এবং মেকানিক্যাল কাজের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো। আগে তিনি খেলনা এক্সকেভেটর মেশিন, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, ড্রোন, অ্যারোপ্লেন, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও স্পোর্টস কার তৈরি করেছেন। খেলনা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে তৈরি করতে পারার পরই তার আত্মবিশ্বাস জন্মায়। এরপর তিনি প্রকৃত স্পোর্টস কার তৈরির পরিকল্পনা করেন। 

রিশান জানান, অত্যাধুনিক মডেলের এই গাড়িটি তৈরি করতে তার সময় লেগেছে ১৫ মাস। খরচ হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখনও ৮০ হাজার টাকার প্রয়োজন তার। যে টাকা হলে ১০ দিনের ভেতর গাড়ির দরজার গ্লাস, হেডলাইট, ব্যাক লাইট এবং ভেতরের অবশিষ্ট থাকা কিছু কাজ করে গাড়িটিকে স্বয়ংসম্পন্নরূপ দেওয়া যাবে।

রিশানের তৈরি করা গাড়ি

রিশান বলেন, ‘মোটরসাইকেল কেনার কথা বলে বাবা’র কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়ে গাড়ি তৈরির কাজ শুরু করি। বগুড়ার ভাংরিপট্টি থেকে টায়ার, রিং, স্টেয়ারিংসহ যাবতীয় যন্ত্রাংশ কিনেছি। চীন থেকে ইঞ্জিন এবং গিয়ারবক্স নিয়ে এসেছি। এছাড়া পাইকারি দরে অ্যালুমিনিয়াম শিট, স্টিল শিট, কার্বন ফাইবার কিনি। গাড়িতে দুটো সিট, স্টেয়ারিং হুইল, গান শোনার জন্য স্পিকার, কুলিংফ্যান রয়েছে। এছাড়া গাড়িটি চাবির পাশাপাশি সেল্ফ সিস্টেমেও চালু করা যায়। গাড়িটি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলে। গাড়িতে মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন ব্যবহার করেছি। পরবর্তীতে এই ইঞ্জিন পরিবর্তন করবো।’

গাড়িটির বিশেষত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গাড়িটি সাসপেনশনের উপর নির্ভর করে বানানো হয়েছে। গাড়িটির সাসপেনশন রেয়ার। যে কারণে গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ সব বজায় থাকে। গাড়িটি এবিএস সিস্টেমের ব্রেক রয়েছে। এটি তিন চাকার উপর দিয়েও চলতে পারবে। এছাড়া গাড়ির সামনে যে চেসিস সিস্টেম দিয়েছি সেটির কারণে পাঁচটন সমান ধাক্কা সহ্য করতে সক্ষম গাড়িটি। আর এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট গাড়ির ইঞ্জিন পেছনে।’  

রিশান আরো বলেন, ‘গাড়ির বডি তৈরি করতে কোনো লেদ মেশিনের সাহায্য নেওয়া হয়নি। হাতে চালিত যন্ত্রের সাহায্যে ঘরের ভেতর বসে ১৫ মাস ধরে গাড়িটি তৈরি করেছি। গাড়ি তৈরি পর সেটি বাইরে আনতে ঘরের দেওয়াল ভাঙতে হয়েছে। গাড়িটি তৈরির পর খুব ভালো লাগছে আমার। এই গাড়িটি মূলত নিজের চলাচলের জন্য তৈরি করেছি। বিক্রি করবো না। তবে কেউ চাইলে যে কোনো মডেল দেখালে সেই অনুযায়ী গাড়ি তৈরি করে দিতে পারবো বলে আমার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে।’ 

রিশান ভবিষ্যতে বগুড়া পলিটেকনিকে পড়াশোনা করতে চান। ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে চান তিনি।  কারণ ছোট থেকে এগুলো করতে ভালো লাগে তার। এই কাজের মধ্যেই তিনি শান্তি খুঁজে পান। এছাড়া তিনি ভবিষ্যতে রোবটিক গাড়ি তৈরি করতে চান। যে গাড়ি কোনো সমস্যা হলে নিজেই চালককে বলে দিতে পারবে গাড়িতে কি সমস্যা হয়েছে।

রিশানের প্রতিবেশিরা জানান, এত অল্পবয়সে এতো বড় একটা জিনিস বানিয়েছেন রিশান এটা আসলেই বিস্ময়কর। তবে যেহেতু আমাদের চোখের সামনে ঘটলো, বিশ্বাস না করে উপায় নেই। 

স্থানীয় একজন রিশানের ঘরের দেয়াল দেখিয়ে বলেন, দেখুন ছেলেটি গাড়ি ওই ঘরের ভেতর তৈরি করেছে। এরপর দেওয়াল ভেঙে গাড়িটি বের করেছে। সে গাড়িও চালাতে পারতো না। গাড়ি বানানোর পরই চালানো শিখেছে।

রিশানের মা ফরিদা বেগম বলেন, ‘যখন গাড়ি তৈরির জিনিসপত্র নিয়ে সে বাসায় আসলো তখন ভয় পেয়েছিলাম। কারণ সে কোনো সামনা সামনি গাড়ি তৈরি করতে দেখেনি। এর আগে খেলনা জিনিস বানিয়েছে রিশান। এখন বড় জিনিস বানাতে পারবে কিনা সন্দেহ ছিলো। অনেক দিন অনেক কষ্টের পর ছেলে আমার গাড়িটি তৈরি করেছে। গাড়িতে প্রথম সে আমাকেই পাশে বসিয়েছিলো। আমি চাই আমার ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার হোক।’

রিশানের বাবা ইউনুস মিয়া বলেন, ‘রিশান কলেজ যাতায়াতের জন্য আমার কাছ থেকে মোটরসাইকেল কেনার জন্য দুই লাখ টাকা নিয়েছিলো। এরপর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে রিশানকে টাকা দেই আমি। পরে জানতে পারি মোটরসাইকেল না কিনে সে গাড়ি তৈরি শুরু করেছে। রিশানের গাড়ি তৈরির জন্য তাকে ব্যাংক লোন, জমি বন্ধক এবং গরু বিক্রি করতে হয়েছে। গাড়ি তৈরির বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রিশান গাড়িটি তৈরি করেই ছাড়লো।’