পজিটিভ বাংলাদেশ

পরিপাটি ও গোছানো গ্রামের নাম বিলাইছড়ি পাংখোয়া পাড়া

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত বিলাইছড়ির পাংখোয়া পাড়া। এই এলাকায় বসবাস করে পাংখোয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। হাজারো দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তারা নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনা থেকে শুরু করে চারপাশ পরিপাটি করে রেখেছেন। 

পাংখোয়া পাড়ার প্রতিটি বাড়ির পাশেই রয়েছে ফুলের গাছ। প্রতিটি রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা যাতায়েতের জন্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ক্ষুদ্র এই নৃগোষ্ঠীর পরিপাটি জীবনযাপন দেখে যে কোনো পর্যটকই মুগ্ধ হন।

রাঙামাটি জেলা সদর থেকে নৌপথে  প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বিলাইছড়ি উপজেলা। এর আয়তন ৭৪৫.৯২ বর্গ কিলোমিটার। বিলাইছড়ি উপজেলাটি একটি দুর্গম এলাকা। জেলা শহর থেকে এই উপজেলায় যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। এরপর উপজেলা সদর থেকে পাংখোয়া পাড়ায় ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যেতে সময় লাগে আরো এক ঘণ্টা।

পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেষে সুউচ্চ পাহাড়ের উপর বসবাস করে। তাদের স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ ভাগ। তারা পাংখোয়া ভাষায় কথা বলার পাশাপাশি শুদ্ধ বাংলা ভাষাতেও কথা বলতে পারদর্শী । ক্ষুদ্র এই নৃগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। তারা তাদের সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালনের ক্ষেত্রে বদ্ধ পরিকর। পংখোয়া সম্প্রদায়ের মানুষরা খুবই অতিথি পরায়ন। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলা জুড়ে তিন হাজার পাংখোয়া বসবাস করলেও বিলাইছড়ি উপজেলার তিন কোনিয়া মৌজার আওতাধীন তথা বিলাইছড়ি ইউনিয়নে পাংখোয়াদের নিয়ে গঠিত হয়েছে পাংখোয়া পাড়া। যেখানে দেড় হাজার পাংখোয়ার বসবাস। ১৯৭৯ সালের ৩০ মার্চ পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর লোকজন এই এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। এক সময়ের যাযাবর পাংখোয়াদের জীবন যাপনের রীতি ও ধর্মে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করে এরপর থেকেই ।প্রকৃতি পূজারী পাংখোয়া জনগোষ্ঠী। তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। তাদের নিজস্ব ভাষা, পোষাক, অলংকার, গান, নাচ এবং জীবন-রীতি রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম। 

বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবান এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পাংখোয়ারা সবচেয়ে বেশি বসবাস করেন। তারা মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশে বসবাসরত সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম।

পাংখোয়া পাড়ার  বাসিন্দা সানাই পাংখোয়া বলেন, ‘এ গ্রামটি যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তেমনি এ পাড়ার বসবাসরত আমরা সবাই একতাবদ্ধ। আমরা মনেকরি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে নিজের  মধ্যেও আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। আমরা আমাদের এ পাড়াটিকে সুন্দর রাখার পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতিকেও লালন করে থাকি।’

পাংখোয়া পাড়ার অপর বাসিন্দা তুংউয়া পাংখোয়া বলেন, ‘প্রায় ৪৩ বছর ধরে আমরা এই গ্রামে বসবাস করছি। এখানে ফুলের গাছ, ফলের গাছ বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো হয়। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। আমরা নিজেরাই সবকিছুর পরিচর্যা করি। এর পেছনে কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান রয়েছে। কারণ তাদের অনুপ্রেরনায় এবং পরামর্শে পাংখোয়া পাড়াটিকে এত সুন্দর রাখতে পেরেছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতেও যাতে পাড়ার সৌন্দর্য্য অটুট থাকে সেই চেষ্টায় আমরা করে যাবো।’ 

বিলাইছড়ি ১ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য চোয়াললেই পাংখোয়া বলেন, ‘পাংখোয়া পাড়াতে আমরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করি। সব সময় আমরা সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকতে পছন্দ করি। এখানে প্রায় সময় অতিথিরা ঘুরতে আসেন। তারা আমাদের পাড়াটি দেখে মুগ্ধ হন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো পর্যটক যদি আমাদের এখানে আসতে চান সেক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে ঘুরতে পারবেন।’

এ প্রসঙ্গে বিলাইছড়ির ১২০ তিনকোনিয়া মৌজার হেডম্যান লাল এ্যাংলিয়ানা পাংখোয়া বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ৩০ মার্চ প্রথম আমরা বিলাইছড়ির এই স্থানে আসি। আমাদের পংখোয়া জনগোষ্ঠী খুবই শান্তিপ্রিয়। আমাদের জীবিকার প্রধান উৎস জুম চাষ। এর পাশাপশি কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসা জমিতেও অনেকে চাষবাস করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। অনেকে আবার সরকারি-বেসরকারি চাকরি করছেন। পাংখোয়া পাড়ায় এখানে ১২০ পরিবারে প্রায় ৬০০-৭০০ লোকের বসবাস।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা পাংখোয়া পাড়া পরিদর্শন করেছেন। মূলত তাদের পরামর্শে আমরা এই গ্রামটিকে এত সুন্দর করে রাখতে পেরেছি। আশা করছি ভবিষ্যতেও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।’