তিন চাকার একটি ভ্যান। চারপাশ হালকা সবুজ রঙের সুন্দর একটি ছাউনি। তার ভেতরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন রকমের বই। টিফিনের সময় শিক্ষার্থীরা এখান থেকে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বই নিয়ে পড়েন। টিফিনের সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইগুলো ভ্যান গাড়িতে রেখে ক্লাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
এমনই এক ব্যতিক্রম ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের সন্ধান মিলেছে পাবনার বেড়া উপজেলায়। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন ভ্রাম্যমান পাঠাগার।’ শিক্ষার্থীদের মাদক ও ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বইয়ের জগতে ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বেড়া উপজেলার ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের উদ্যোক্তা।
সরেজমিনে বেড়া উপজেলার বেড়া পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা টিফিনের সময় তাদের ইচ্ছেমতো বই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার থেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে বা ভবনের বারান্দায় বসে পড়ছেন। ভ্যানটির উপরের ছাউনিতে লেখা ‘পাঠাগারের স্বার্থকতা হাসপাতালের চাইতেও কম নয়’, ‘নিজে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, অন্যকে বই পড়কে উদ্বুদ্ধ করুন।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ আগস্ট একটি ভ্যানে পথচলা শুরু এই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের। গত ৩০ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভ্যানে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার কার্যক্রমে যুক্ত হয়। এই পাঠাগারে গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্প, ইসলামিক, শিশুতোষ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীসহ বিভিন্ন বই রয়েছে।
পাঠাগারটি সাতদিন করে উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে থাকবে। সেসময় যে স্কুলে পাঠাগারটি থাকবে সেখানকার শিক্ষার্থীরাই তার দায়িত্বে থাকবে। পাঠাগারটি শুধুমাত্র স্কুলের টিফিনের সময় খোলা হয়। শিক্ষার্থীরা টিফিনের সময় হলেই চলে আসেন পাঠাগারে পছন্দের বই পড়তে। টিফিন শেষ হওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে এই বইগুলো আবার ফেরত দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যান। এছাড়া খাতায় নাম ঠিকানা লিখে বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। প্রথমে ৭০০ বই নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সচেতন মানুষদের অনুদানে বর্তমানে পাঠাগারটিতে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় হাজার।
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মেহেরাব হোসেন (জিম) বলেন, ‘গল্প হোক বইয়ের সঙ্গে-এই স্লোগানে ভ্রাম্যমাণ ভ্যান পাঠাগারটি করা। বেড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহা. সবুর আলীর সহযোগিতায় দুটি ভ্যানে পাঠাগার চালু করা হয়। আমাদের শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের মাদকের নেশা, মোবাইল গেমিংসহ বিভিন্ন অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখতে পাঠাগারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।’
বেড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আহাদ সরকার ও রেজোয়ান আহমেদ বলেন, ‘পড়ার ফাঁকে অবসর সময়ে আমাদের স্কুলের অনেকেই মোবাইল ব্যবহার করতো। আবার অনেকেই বাইরে আড্ডা দিতো। এখন ভ্যান পাঠাগার থেকে বই বাড়িতে নিয়ে পড়ে অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারছি।’
বেড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী আছিয়া খাতুন ও সপ্তম শ্রেণীর জুথী খাতুন বলেন, ‘আমরা নিজেরাই পাঠাগারটি দেখাশোনা করি। টিফিনের সময় হলে পাঠাগারের পর্দাটি সরিয়ে দেই। তারপর সবাই সবার পছন্দের বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করে।দেখা যাচ্ছে, সবাই গল্প করে সময় নষ্ট না করে বই পড়ছে। পাঠ্যবইয়ের পড়ার বাইরে আলাদা জ্ঞান লাভের সুযোগ তৈরী করেছে এই পাঠাগার।’
জোড়গাছা ডিগ্রি কলেজের জ্যৈষ্ঠ প্রভাষক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষা বিস্তারে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় পাঠাগার স্থাপন হওয়া দরকার। একটি তথ্যনির্ভর ও আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ায় সম্পৃক্ত করতে পারলে সমাজের অনেক ভালো কাজ সম্ভব। শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।’
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন ইউএনও হিসেবে যোগদান করার পর পাঠাগারটি সম্পর্কে জেনেছি। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এখন তো স্কুলের পড়ালেখা শেষে শিক্ষার্থীরা নেট দুনিয়ায় সময় কাটায়। ফলে অনেকে শিক্ষার্থী একাকীত্ব আর মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। নতুন প্রজন্মকে অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথে ফেরাতে বই পড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এই পাঠাগারটি যেন আরো সম্প্রসারিত হয় সে বিষয়ে সহযোগিতা করবো।’