পজিটিভ বাংলাদেশ

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’: বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন জয়গান

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়। শুধু অভ্যন্তরীণ জলাশয় নির্ভর নয়, চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চীনের পরেই দ্বিতীয়। এই অর্জন কেবল পরিসংখ্যানগত নয় এটি মাঠের মৎস্যচাষী, সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক এবং প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সম্মিলিত সফলতার প্রতিচ্ছবি।

চাষকৃত মাছ উৎপাদনে অভাবনীয় অগ্রগতি ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে, যার মধ্যে ৩১ লাখ মেট্রিক টন এসেছে চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছ থেকে। প্রতি বছর গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে এই উৎপাদন বাড়ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধি।

এফএও-এর বিশ্ব মৎস্য ও জলজ কৃষি প্রতিবেদন ২০২৪ এ বাংলাদেশের অগ্রগতি ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে।

পরিকল্পনা ও মাঠপর্যায়ে সমন্বয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন (চলতি দায়িত্ব) বলেন, “এই অর্জন হঠাৎ আসেনি। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ধারাবাহিক বিনিয়োগ এবং চাষিদের প্রশিক্ষণের ফল। নদ-নদী, হাওর, এমনকি বৃষ্টির পানিও আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি আধুনিক ব্যবস্থাপনায়। তৃণমূলের মৎস্যচাষীরা এখন জানেন কীভাবে পরিবেশবান্ধবভাবে উৎপাদন বাড়াতে হয়।”

তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু পরিমাণ নয়, নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা। যাতে করে দেশীয় মাছের জাত রক্ষা পায় এবং রপ্তানির বাজারেও আমাদের অবস্থান মজবুত হয়।”

এখন সময় গুণগত মানে বিনিয়োগের মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “মৎস্য খাতকে আগে শুধু উৎপাদন নির্ভর মনে করা হতো। কিন্তু এখন আমরা জানি, উন্নতমানের রেণু, পুষ্টিকর খাবার, নিরাপদ জলাশয় ও আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া এই অগ্রগতি ধরে রাখা যাবে না।”

তিনি আরো বলেন,“নারীদের অংশগ্রহণ, তরুণ উদ্যোক্তাদের হ্যাচারি ব্যবসায় উৎসাহ এবং গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাতকে টেকসইভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।”

গবেষণা ও প্রযুক্তিতে গতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই তিন প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করছে নতুন জাতের মাছ উদ্ভাবন ও হ্যাচারি উন্নয়নে।

পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও কার্প জাতীয় মাছের উন্নতজাত চাষে ইতোমধ্যে সাফল্য এসেছে। পাশাপাশি বায়োফ্লক (জৈব-পদ্ধতিনির্ভর চাষ), আরএএস (পুনঃচক্র জল ব্যবস্থাপনা) ইত্যাদি আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার মাছচাষীদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে।

এছাড়া ডিজিটাল খামার ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি চালু হওয়ায় উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি রোগের প্রকোপও কমেছে।

প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জলাশয় রয়েছে যার মধ্যে পুকুর, দীঘি, হাওর, বিল, প্লাবনভূমি উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে যেখানে মাত্র ৪৫ শতাংশ পুকুরে মাছ চাষ হতো, এখন তা বেড়ে ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

দেশের প্রতিটি জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন, প্রজনন ও চাষীদের দক্ষতা বৃদ্ধি নিশ্চিত হচ্ছে।

রপ্তানির নতুন দিগন্ত উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চিংড়ি ও তেলাপিয়ার রপ্তানি বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩৪ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি এবং ১২ হাজার মেট্রিক টন তেলাপিয়া। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সরকার ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ, হালাল প্রক্রিয়াকরণ এবং উত্স শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (ট্রেসেবিলিটি) উন্নয়নে কাজ করছে।

যেসব চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে সবকিছু সত্ত্বেও খাতটি এখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রজনন সময়ে গড়মিল। জলাশয় দখল ও দূষণ বৃদ্ধি। মাছের খাদ্যে ভেজাল ও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার। দক্ষ চিকিৎসক ও পরামর্শক সংকট।

সমাধান কী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, এখনই সময় ‘স্মার্ট ব্যবস্থাপনা’ নিশ্চিত করার। সব হ্যাচারিকে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাছচাষে বিমা সুবিধা চালু করা দরকার। গবেষণা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে মৎস্য স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র চালু করতে হবে। নিরাপদ মাছ সরবরাহে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।

কুমিল্লার মৎস্যচাষী রুহুল আমিন বলেন, “আগে নিজের অভিজ্ঞতায় মাছ চাষ করতাম। এখন প্রশিক্ষণ পাই, মোবাইল অ্যাপে তথ্য পাই। মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু বাজার যেন ভালো থাকে, সেটাই চাই।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাহিদ হাসান বলেন, “আগে আমরা ভাবতাম, মৎস্য চাষ কেবল গ্রামের পুকুরেই সীমাবদ্ধ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা করছি জিনগত উন্নয়ন, টেকসই জল ব্যবস্থাপনা ও মৎস্য রোগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। বাস্তব জীবনে এসব প্রয়োগ হচ্ছে দেখে আগ্রহ আরো বেড়েছে।”

তিনি আরো বলেন,“সরকার যদি আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের স্টার্টআপ বা গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করে, তাহলে মৎস্য খাত থেকে শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হওয়ারও সুযোগ তৈরি হবে। এটা এখন শুধু একটি খাত নয় এটা আমাদের ভবিষ্যৎ।”

তিনি বলেন, “আজকের বাংলাদেশে মৎস্য খাত কেবল একটি উৎপাদন খাত নয় এটি খাদ্য নিরাপত্তা, বৈদেশিক মুদ্রা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বর্তমান সরকার যদি প্রযুক্তি, নীতি ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাকে সমন্বয় করে অগ্রসর হয় তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরো ঊর্ধ্বমুখী হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।”