প্রতিবছর রেলের ব্যবহার বাড়ছে। ট্রেন লাইনচ্যুতি বা দুর্ঘটনার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেললাইন সংস্কার ব্যয়বহুল ও আধুনিক যন্ত্রের জোগান পর্যাপ্ত না থাকায় মাঝে মধ্যেই দেখা দেয় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়।
এই সংকট নিরসনে মাত্র ২৭ হাজার ৫০০ টাকায় ‘রেল কাটিং মেশিন’ তৈরি করেছেন পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ নাজিব কায়সার বিন্দু। এই মেশিন জার্মানি থেকে আমদানিতে খরচ হয় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা।
দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি মেশিনটির ওজন প্রায় ৩৫ কেজি। ৭.৫ হর্স পাওয়ার বিশিষ্ট পেট্রোল ইঞ্জিনের সাহায্যে মেশিনটি পরিচালিত হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা যে মেশিন রেললাইন কাটতে কয়েক মিনিট সময় নেয়, সেখানে নাজিব কায়সারের তৈরি করা মেশিনটির সময় লাগে ১ মিনিট ২০ সেকেন্ড।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেশিনটি যদি মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, টেকসই হয়; তাহলে সরকারি উদ্যোগে তৈরি করে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে সরবরাহ করা হবে।
প্রকৌশলী নাজিব কায়সার ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন।
আলাপকালে পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ নাজিব কায়সার বিন্দু বলেন, “এই রেল কাটিং মেশিনের বিশেষত্ব হলো, এটিতে যেকোন সাইজের কাটিং ডিস্ক ব্যবহার করা যায়। মেশিনটি রেললাইনে ট্রেন লাইনচ্যুত কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেল কর্মচারীদের তাৎক্ষণিক দ্রুতসময়ে রেললাইন কাঁটতে সাহায্য করবে। মাত্র ১ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময়ে রেলপাতকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়। ৭.৫ হর্স পাওয়ার বিশিষ্ট পেট্রোল ইঞ্জিন দ্বারা মেশিনটি পরিচালিত হয়। এটা একটি পোর্টেবল মেশিন, যার ওজন প্রায় ৩৫ কেজি।”
তিনি বলেন, “আগে যতগুলো রেল কাটিং মেশিন কেনা হয়েছে, সেগুলো জার্মানি থেকে আমদানি করা। যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। মেশিনগুলো বিদেশ থেকে আনতেও অনেক সময় লাগে। সেই মেশিন দিয়ে রেললাইন কাটতে কয়েক মিনিট লাগতো। আমার তৈরি করা মেশিন মাত্র ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডে একটি রেললাইন প্রস্থ বরাবর কাটা যায়।”
তিনি আরো বলেন, “মেশিনটি তৈরি করা হয়েছে ঈশ্বরদীস্থ প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারী দিয়ে। প্রথম বানানো এ কারণে বেশি সময় লেগেছে। এই রেল কাটিং মেশিন বানাতে সর্বোচ্চ পাঁচদিন সময় লাগবে, যদি যন্ত্রাংগুলো বাজারে সহজে পাওয়া যায়।”
“আমি দেশকে ভালোবাসি। দেশের টাকা দেশে রাখাতে চাই। আমর মূলত দেশীয় প্রযুক্তিতে রেল কাটিং বানানোর ইচ্ছে ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। সেই ইচ্ছেকে বাস্তবেই রূপ দিয়েছি”, যোগ করেন এই প্রকৌশলী।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আবু জাফর বলেন, “ব্রিটিশ আমলে হেচকো ব্লেড দিয়ে রেললাইন কাটতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত। জার্মানি থেকে আমদানি করা মেশিনে কয়েক মিনিট সময় লাগে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কাটিং মেশিনটি দিয়ে আমরা ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে একটি রেলকে প্রস্থ বরাবর কাটতে পারছি, এতে আমাদের সময় সাশ্রয় হচ্ছে।”
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) লিয়াকত শরীফ খান বলেন, “কম খরচে, দেশীয় প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তায় রেল কাটিং মেশিনটি তৈরি করা হয়েছে। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীরা পরীক্ষামূলকভাবে কাটিং মেশিন দিয়ে কাজ করছেন। যদি টেকসই হয়, তাহলে ঈশ্বরদী ওয়ার্কসপ থেকে সরকারি খরচে রেল কাটিং মেশিন তৈরি করা হবে।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) আফজাল হোসেন বলেন, “পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী-২ নাজিব কায়সার নতুন মেশিন তৈরি করেছেন সে সম্পর্কে জেনেছি। তিনি ব্যক্তিগত খরচে তৈরি করেছেন রেল কাটিং মেশিনটি। এটি খুবই ভাল উদ্ভাবন। যদি মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, টেকসই হয়, তাহলে সরকারি উদ্যোগে মেশিনটি তৈরি করে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে সরবরাহ করা হবে।”
১৯৮৯ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজশাহীতে জন্ম নাজিব কায়সারের। তিনি প্রকৌশলী নাজিমুল হক-লুৎফেয়ারা বেগম দম্পত্তির একমাত্র সন্তান। তার বাবা নাজিমুল হক বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন।
নাজিব কায়সার ২০০৫-০৬ সেশনে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেন। তিনি ৩৩ তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।