দেহঘড়ি

চিকিৎসা খাতে অদ্ভুত যত ঘটনা (শেষ পর্ব)

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চিকিৎসা বিজ্ঞান এতটা অগ্রসর হয়েছে যে, এখন আমরা উপযুক্ত চিকিৎসা বা টিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রাণনাশক রোগের হাত থেকেও জীবনকে রক্ষা করতে পারি। এ অগ্রগতির পেছনে সকল ধরনের অসুস্থতা অথবা অদ্ভুত শারীরিক ঘটনার কিছু না কিছু অবদান রয়েছে, কারণ শারীরিক রোগ অথবা আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখলে বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা ও সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। ২০১৯ সালে চিকিৎসা জগতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত কিছু ঘটনা নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

বুকে আগুন

২০১৯ সালে এক ব্যক্তির হার্ট সার্জারির সময় বুকে আগুন ধরে যায়! এটা কিন্তু স্বাভাবিক দহনক্রিয়া নয়। এটি হচ্ছে বিরল অস্ত্রোপচার জনিত জটিলতা, যা বিশেষ পরিস্থিতে ঘটে থাকে। ৬০ বছর বয়সি লোকটির বুকের ধমনীতে জীবন আশঙ্কামূলক ছেঁড়া সারিয়ে তুলতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়েছিল, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব অ্যানেস্থেশিওলজির সভায় জুনে উপস্থাপিত প্রতিবেদন অনুসারে। এ লোকটির দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুস রোগের ইতিহাস ছিল এবং অস্ত্রোপচারের সময় শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা এড়াতে চিকিৎসকেরা তাকে উচ্চ ডোজে সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেন দিয়েছেন। চিকিৎসকেরা রক্তনালীর রক্তক্ষরণ থামাতে ইলেক্ট্রিসিটি দিয়ে টিস্যুতে তাপমাত্রা সরবরাহ করতে একটি ইলেক্ট্রোকটারি ডিভাইসও ব্যবহার করেছেন। হঠাৎ ইলেক্ট্রোকটারি ডিভাইসের স্ফুলিঙ্গ থেকে সার্জিক্যাল গজে আগুন ধরে যায়। দ্রুত স্যালাইন বা লবণ পানি দিয়ে এ আগুনে নেভানো হয়। এতে রোগীটির কোনো ক্ষতি হয়নি। সম্ভবত সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেনের ব্যবহারে এ আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অক্সিজেন নিজে নিজে জ্বলে না, কিন্তু এটি তাপমাত্রা কমিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে আগুন ধরে যেতে পারে। এ দুর্ঘটনা সত্ত্বেও চিকিৎসকেরা সফলতার সঙ্গে অস্ত্রোপচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, অর্থাৎ তারা সফলতার সঙ্গে রক্তনালীর ছেঁড়া মেরামত করতে পেরেছেন।

হেয়ার স্প্লিন্টার

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দোষ কারণে চুল পড়ে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো ঝরে পড়া চুল ত্বকের মধ্যে গেঁথেও যেতে পারে, যাকে হেয়ার স্প্লিন্টার বলা যাবে। ব্রাজিলে ৩৫ বছর বয়সি এক লোকের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। তিনি ডান গোড়ালিতে অদ্ভুত ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ ব্যথা হাঁটার সময় আরো বেড়ে যেত। প্রথম দেখাতে চিকিৎসকেরা মারাত্মক কিছু দেখেননি। কিন্তু গোড়ালিতে আরো ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেল যে, তার পায়ের তলায় একটি চুল গেঁথে আছে। চিকিৎসকেরা তার এ দশাকে কিউটেনিয়াস পিলি মাইগ্রানস হিসেবে শনাক্ত করছেন। কিউটেনিয়াস পিলি মাইগ্রানস হচ্ছে একটি বিরল দশা, যেখানে ত্বকের পৃষ্ঠে চুল গেঁথে যায়। বিগত ৬০ বছরে এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র ২৬টি। চিকিৎসকেরা টুইজার দিয়ে চুলটি অপসারণ করেন (যার পরিমাপ ছিল মাত্র ০.৪ ইঞ্চি বা ১০ মিলিমিটার) এবং লোকটি তৎক্ষণাৎ ব্যথা থেকে মুক্তি পান, ২০ জুনে দ্য জার্নাল অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী।

জাঙ্ক ফুডের প্রভাবে অন্ধত্ব

জাঙ্ক ফুডের ডায়েট শুধুমাত্র কোমর ও হার্টের জন্যই ক্ষতিকারক নয়, এসব খাবার চোখেরও ক্ষতি করতে পারে। ২ সেপ্টেম্বরে অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের এক কিশোর ফ্রাইজ, চিপস ও অন্যান্য জাঙ্ক ফুড ছাড়া অন্যকিছু তেমন খেত না, কিন্তু নিম্নমানের ডায়েটের কারণে সে ধীরে ধীরে কিছু বছরের মধ্যে প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। জাঙ্ক ফুডে আসক্ত এ কিশোরের ১৪ বছর বয়সে ভিটামিন বি১২ ঘাটতি ধরা পড়ে, ১৫ বছর বয়সে শ্রবণ ও দৃষ্টি সমস্যা দেখা দেয় এবং ১৭ বছর বয়সে উভয় চোখই লিগ্যালি ব্লাইন্ড (দৃষ্টিশক্তি কমে ২০/২০০-তে নেমে আসা) হয়ে গেছে। টেস্টে দেখা গেছে, কিশোরটির অপটিভ নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপটিক নার্ভ হচ্ছে নার্ভ ফাইবারের একটি বান্ডেল যা চোখের পেছনটাকে মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত করে। চিকিৎসকেরা কিশোরটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে সে শুধুমাত্র ফ্রাইজ, চিপস, হোয়াইট ব্রেড, প্রসেসড হ্যাম স্লাইস ও সসেজ খেত। চিকিৎসকেরা তার সমস্যাটিকে নিউট্রিশনাল অপটিক নিউরোপ্যাথি (পুষ্টির অভাবে অপটিক নার্ভে ড্যামেজ) হিসেবে শনাক্ত করেছেন। এটা জেনে রাখা ভালো যে, অনেক কোষীয় কার্যক্রমের জন্য বি ভিটামিন গুরুত্বপূর্ণ- এই ভিটামিনের অভাবে বিষাক্ত বাইপ্রোডাক্ট সঞ্চিত হয়, যা শেষপর্যন্ত স্নায়ুকোষকে ড্যামেজ করে। কিশোরটি যতটুকু দৃষ্টি হারিয়েছে তা স্থায়ী, কিন্তু আরো দৃষ্টি ক্ষয় প্রতিরোধে তাকে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করা হয়েছে। ইটিং ডিসঅর্ডারের জন্য তাকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছেও রেফার করা হয়েছে।

আইরিস সরে যাওয়া

আপনি হয়তো আইরিস বা চোখের রঙিন অংশ সরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না, কিন্তু কিছু ইনজুরি এরকম ঘটাতে পারে। তাইওয়ানের একজন লোকের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। একটি ইনজুরিতে তার আইরিস স্বাভাবিক স্থান থেকে সরে গিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। ১০ এপ্রিল দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে এ কেসের প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। লোকটির বাম চোখে বাঙ্গি কর্ড গেঁথে যাওয়ার পর তাকে আই ক্লিনিকে আনা হয়েছিল। তিনি চোখে ব্যথা অনুভব করেন ও একই জিনিস দুটি করে দেখতে শুরু করেন। চিকিৎসকেরা এ সমস্যাটিকে ট্রমাটিক আইরিডোডায়ায়ালাইসিস বলেছেন। ট্রমাটিক আইরিডোডায়ায়ালাইসিস হচ্ছে চোখের একপ্রকার ইনজুরি, যখন ট্রমার কারণে আইরিস তার পেছনের বৃত্তাকার গঠন বা সিলিয়ারি বডি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। লোকটির আইরিসকে পূর্বের অবস্থানে বসানোর জন্য আইরিডোপ্লাস্টি নামক অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা চোখের তারার এ ক্ষতি মেরামতে সফল হয়েছিলেন এবং লোকটির হারানো দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার হয়েছিল।

দুধময় রক্ত

একটা লোকের রক্তে চর্বির ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে এ রক্ত দুধের রঙে রূপ নিয়েছে। ৩৯ বছর বয়সি এ লোকের ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু তিনি নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করতেন না, ২৫ ফেব্রুয়ারিতে অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এ কেসের প্রতিবেদন অনুসারে। বমিভাব, বমি, মাথাব্যথা ও হ্রাসমান চেতনা নিয়ে তিনি হাসপাতালে এসেছিলেন। টেস্টে দেখা গেছে, তার রক্তে অস্বাভাবিক উচ্চ মাত্রায় ট্রাইগ্লাইসেরাইডস নামক চর্বি ছিল। প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ট্রাইগ্লাইসেরাইডসের মাত্রা ১৫০ মিলিগ্রামের নিচে থাকাকে স্বাভাবিক বিবেচনা করা হয় এবং ৫০০ এর উপরে হলে খুব উচ্চ বলে ধরা হয়। এ কেসের লোকটির প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ট্রাইগ্লাইসেরাইডসের মাত্রা ছিল ১৪,০০০ মিলিগ্রামেরও বেশি। চিকিৎসকেরা লোকটির রক্ত থেকে চর্বি পরিস্রাবণ করতে একটি মেশিন ব্যবহার করেন। এ প্রক্রিয়াটি প্লাজমাফেরিসেস নামে পরিচিত। কিন্তু অস্বাভাবিক উচ্চ মাত্রার রক্ত চর্বির কারণে মেশিনটিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তাই চিকিৎসকেরা লোকটির জীবন বাঁচাতে ব্লাডলেটিং প্রক্রিয়ায় চলে যান। এটি হচ্ছে উচ্চ মাত্রার ট্রাইগ্লাইসেরাইডস বা হাইপারট্রাইগ্লাইসেরাইডেমিয়ার চিকিৎসা করতে প্রথম ব্লাডলেটিং কেস। তথ্যসূত্র : লাইভ সায়েন্স পড়ুন :  

ঢাকা/ফিরোজ