দেহঘড়ি

করোনাভাইরাসের সংখ্যা কি অসুস্থতার মাত্রা নির্ধারণ করে?

স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন অনেক করোনাভাইরাস রোগীর সংস্পর্শে আসছেন। তত্ত্বীয়ভাবে, একজন স্বাস্থ্যকর্মী যত বেশি কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসবেন, তার শরীরে তত বেশি করোনাভাইরাস প্রবেশের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

এর মানে হলো, স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। অন্তত কিছু দেশের প্রতিবেদন এমনটা বলছে। কিন্তু শরীরে কতগুলো করোনাভাইরাস প্রবেশ করছে তার ওপর ভিত্তি করে কি কোভিড-১৯ এর মাত্রা কিংবা তীব্রতা নির্ধারিত হয়?

আমরা জানি যে, কিছু রোগের ক্ষেত্রে একজন মানুষ কতটি ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছেন তার সঙ্গে রোগের তীব্রতার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। তেমন ঘটনার একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব সুস্থ স্বেচ্ছাকর্মীদের শরীরে যত বেশি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়েছিল তাদের উপসর্গের তীব্রতা তত বেড়েছে। ভাইরাস হচ্ছে অতিক্ষুদ্র কণা, যা প্রতিলিপি তৈরি করতে অবশ্যই আমাদের কোষে প্রবেশ করতে হবে। তাই লজিক হচ্ছে, শরীরে যত বেশি ভাইরাস ঢুকবে তত বেশি কোষ সংক্রমিত হবে।

কিন্তু ভাইরাসেরা অতিদ্রুত প্রচুর প্রতিলিপি তৈরি করে থাকে। একটি সংক্রমিত কোষ থেকে শতশত ভাইরাস কণা উৎপন্ন হতে পারে। যার মানে হলো, কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে শরীরে অল্পসংখ্যক ভাইরাস ঢুকলেও সংক্রমণ সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার ক্ষেত্রে শরীরে সংক্রমণ তৈরি করতে মাত্র ১৮টি নরোভাইরাস কণার দরকার পড়ে। নরোভাইরাস সংক্রমণের দুটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো বমি ও ডায়রিয়া। এ ধরনের সংক্রমণ সৃষ্টিকারী ভাইরাসেরা শরীরে এত দ্রুত প্রতিলিপ তৈরি করে যে একজন মানুষ সামান্য সংখ্যক ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলেও সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন।

একজন মানুষ শুরুতে যতগুলো ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন তাকে ভাইরাসের প্রাথমিক ডোজ বলে। সার্স-কভ-২ অথবা কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের প্রাথমিক ডোজের সঙ্গে রোগটির তীব্রতার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে? এ মুহূর্তে আমরা জানি না। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্যই এক্সপেরিমেন্টাল চ্যালেঞ্জ স্টাডি করতে হবে, যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে সুস্থ স্বেচ্ছাকর্মীদেরকে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত করে কোভিড-১৯ এর উপসর্গ ও চিকিৎসা মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু রোগটির কার্যকরী ওষুধ হাতে না আসা পর্যন্ত এরকম গবেষণা নৈতিকতার বাইরে পড়ে। এভাবে একজন স্বেচ্ছাকর্মীকে সংক্রমিত করলে শরীরে কতগুলো ভাইরাস তৈরি হয়েছে তা নিরূপণ করা সহজ হয়ে পড়ে। শরীরে একটি নির্দিষ্ট ভলিউমে ভাইরাসের মোট পরিমাণকে ভাইরাল লোড বলে।

এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসের আন্তর্জাতিক আদর্শ পরীক্ষা সংখ্যাত্মক। শুধু পজিটিভি অথবা নেগেটিভের পরিবর্তে ডায়াগনস্টিক টিমগুলো শূন্য থেকে ৪০ পর্যন্ত একটি সংখ্যাও পেয়ে থাকেন। এ সংখ্যাটি সিটি ভ্যালু অথবা থ্রেসহোল্ড সাইকেল নামে পরিচিত। আপনি হয়তো ভাবছেন যে এ মান বেশি হলে ভাইরাসের সংখ্যাও বেশি হবে। কিন্তু না, এর বিপরীতটাই সত্য- অর্থাৎ এ মান যত কম হবে একজন রোগীর নমুনাতে ভাইরাসের সংখ্যা তত বেশি হবে। সংখ্যা ১৫ এর নিচে হলে নমুনাতে উচ্চ পরিমাণে ভাইরাস রয়েছে, অন্যদিকে সংখ্যাটি ৩৫ এর চেয়ে বড় হলে নমুনাতে খুব কম সংখ্যক ভাইরাস রয়েছে।

এখন অবধি করোনাভাইরাসের প্রাথমিক ডোজ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত উপাত্তের অভাব রয়েছে। তারপরও গবেষকরা এটা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন যে উচ্চ ভাইরাল লোডে কোভিড-১৯ এর তীব্রতা বেশি কিনা। চীনের একটি গবেষণা সাজেস্ট করছে, একজন কোভিড-১৯ রোগী কতটা অসুস্ত হবেন তা করোনাভাইরাসের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু অন্য একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মৃদু উপসর্গযুক্ত কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনাতে ভাইরাসের সংখ্যা কম ছিল।

আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করা জরুরি

এটা মনে রাখা দরকার যে কতগুলো করোনাভাইস দ্বারা সংক্রমণ সৃষ্টি হচ্ছে তা এ গল্পের একটি অংশ মাত্র। কোভিড-১৯ এর তীব্রতা বাড়াতে পারে এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে। রোগীদের শরীর ভাইরাসটির প্রতি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেটা বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ভাইরাসের প্রতি ইমিউন সিস্টেম তথা শরীরের রোগপ্রতিরোধ তন্ত্রের প্রতিক্রিয়াকে ইমিউন রেসপন্স বলে। এ ইমিউন রেসপন্স সহায়ক ও ক্ষতিকারক উভয় হতে পারে। ইমিউন সিস্টেম যথেষ্ট সক্রিয় না থাকলে ভাইরাসটি দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে ইমিউন সিস্টেম অতিক্রিয়াশীল হলে সুস্থ টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণকে তীব্র করে তোলে এমন স্বাস্থ্য সমস্যার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যেমন- ফুসফুসের রোগ, হার্টের রোগ, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস। ক্লান্তি ও অত্যধিক মানসিক চাপে থাকা রোগীদেরও কোভিড-১৯ জনিত তীব্র অসুস্থতার ঝুঁকি রয়েছে।

তথ্যসূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ঢাকা/ফিরোজ