দেহঘড়ি

যে কারণে লকডাউনে বেশি ক্লান্তি লাগছে

অনেক মানুষ সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করেছেন, তারা লকডাউনে সচরাচরের চেয়ে বেশি ক্লান্তি অনুভব করছেন। এ বিষয়টি তাদেরকে অবাক করছে। তারা ভাবছেন, ঘরে তেমন কাজ না করেও ক্লান্তি লাগছে কেন? আবার অনেকের মনে প্রশ্ন উঁকি মারছে যে রাতে দেরিতে ঘুমাতে যাবার কারণে কি এমনটা হচ্ছে?

এখন আপনি যে ক্লান্তি অনুভব করছেন তার সঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মানসিক বোঝা সম্পৃক্ত থাকতে পারে, শারীরিক পরিশ্রম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মনস্তাত্ত্বিক কারণেও মানুষের ক্লান্তি লাগতে পারে, যেমন- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে একঘেয়েমি জীবনযাপনেও ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে। এই যে আপনি করোনাভাইসের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনস্তাত্ত্বিক চাপে আছেন তা হয়তো আপনাকে শারীরিক ক্লান্তি অনুভব করাচ্ছে। তাহলে শক্তি ফিরে পাওয়ার উপায় কি?

সমন্বয় পর্ব: জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে (যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নতুন শিক্ষাজীবন শুরু করা অথবা নতুন দেশে যাওয়া) নিজেকে অচেনা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সময়ের একটা দৈর্ঘ্য লাগে। এটাকে আমরা অভিযোজন বা সমন্বয় পর্ব বলতে পারি। খুব অল্প সময়ে এ অভিযোজন পর্ব শেষ হয় না, সময় নিয়ে ধাপে ধাপে হয়।

অভিযোজনের প্রথম ধাপে নিজেকে আগের জীবনযাপন ও কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত রাখতে হয়, সেইসঙ্গে নতুন পরিবেশের প্রাত্যহিক রীতিনীতি বোঝার চেষ্টা করতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে অনেককিছু নিজের আয়ত্ত্বে চলে আসে, তারপর জীবন অনেকটা সহজ ও অনুমেয় হয়ে ওঠে।

লকডাউনের প্রথম কয়েক সপ্তাহে খারাপ লাগতে পারে ও মন গুমরে কাঁদতে পারে। এটা হচ্ছে অভিযোজনের স্বাভাবিক ধাপ। কিন্তু এ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না, নিজেকে আশ্বস্ত করুন যে এখন আমার ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা অধিকাংশ মানুষের জীবনেও ঘটছে এবং পরের সপ্তাহে আমি ভালো অনুভব করতে পারব।

নতুন ধারার জীবনে পূর্ণ কার্যক্রমের অভিযোজন আসতে প্রায় তিন মাস সময় লাগতে পারে। কিন্তু নতুন পরিবেশে আসার তৃতীয় সপ্তাহ বা এর কাছাকাছি সময়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়, কারণ এসময় একজন ব্যক্তি হঠাৎ করে বিষাদে আক্রান্ত হতে পারেন ও মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারেন। লকডাউন পরিস্থিতিতেও এমনটা হতে পারে। কিন্তু আপনি আশ্বস্ত থাকুন যে এ ধাপ পার হয়ে গেলে নিরাশা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

রুটিন তৈরি: লকডাউনের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে ক্লান্তির অনুভূতি প্রতিরোধ করতে তথা মনোবল ধরে রাখতে স্ট্রাকচারকে প্রাধান্য দিতে হবে, অর্থাৎ কখন কি করবেন তা নির্ধারণ করতে হবে। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদাসীনতা, বিষাদ, নিরাশা অথবা প্রেরণার ঘাটতি থেকে ক্লান্তির অনুভূতি আসতে পারে। তাই মনকে ভালো রাখতে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা চাই। মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ রুটিন তৈরি করা আবশ্যক।

রুটিন আমাদের জীবনে কিছু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে। এর ফলে অনর্থক সময়ক্ষেপণ প্রতিরোধ হয়, আত্মবিশ্বাস বজায় থাকে ও ক্লান্তির অনুভূতি এড়ানো যায়। কাজের নির্দিষ্ট সূচি না থাকলে লোকজন উদাসীন হয়ে পড়েন, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুমান ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করেন।

এই লকডাউনে কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়না নেই বলে আপনার ঘুমের শিডিউলে বড় পরিবর্তন আসতে পারে, যেমন- টিভি বা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে দীর্ঘরাত জেগে থাকা অথবা সকালে দেরিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা। এর ফলে অন্যান্য কাজকর্মেও বিশৃঙ্খলা চলে আসতে পারে। বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে মানসিক স্বাস্থ্য দুর্দশাগ্রস্ত হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে ক্লান্তির মতো সাধারণ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই শক্তির মাত্রা ক্লান্তির পর্যায়ে যাওয়া এড়াতে কর্মসূচি ঠিক করা ভালো। এই কর্মসূচিতে সামাজিক যোগাযোগও থাকতে হবে, হোক না তা অনলাইনে।

ক্লান্তির অন্যতম অশারীরিক কারণ হচ্ছে উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা। এই মহামারিতে লোকজন বিভ্রান্ত ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। কেউ কেউ প্রায়সময় ভাবছেন কে জানে কখন কি সংকটে পড়তে হয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুশ্চিন্তাতে দুশ্চিন্তা বাড়ে, যার প্রভাব শরীরেও পড়ে। এসব দুশ্চিন্তা ঘুমচক্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ক্লান্তিতে ভোগাতে পারে।

সারকথা হচ্ছে, মানসিক বিপর্যয় জনিত ক্লান্তি এড়াতে কর্মের সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে, যেমন- নির্দিষ্ট সময় ধরে শরীরচর্চা করা, অনলাইনে ক্লাস করা ও উপন্যাস পড়া। কাজকর্মের ফলে যে ক্লান্তি আসে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে যে ক্লান্তির সূত্রপাত হয় তা ভালোকিছু নয়। তাই এই লকডাউনে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে রুটিন তথা কর্মপরিকল্পনা করে ফেলুন। আর একটি কথা, ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী থাকুন- এতে উদ্বেগ ও ক্লান্তি দুটোই কমবে। ঢাকা/ফিরোজ