দেহঘড়ি

করোনা সংক্রমণে চার অস্বাভাবিক ঘটনা

কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের উৎপত্তির ছয়মাস অতিবাহিত হলো। সংক্রমণটিতে ইতোমধ্যে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু এখনো গবেষকরা শতভাগ কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবনের খবর দিতে পারেননি।

তবে গবেষকরা হাল ছেড়ে দেয়ার মতো মানুষ নন। মানুষের জীবন বাঁচাতে তারা করোনাভাইরাস নিয়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিরলস গবেষণার কারণে ইতোমধ্যে করোনা সংক্রমণের অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে। সংক্রমণটিতে রোগীর শরীরে প্রত্যাশিত ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি কিছু অবাক করা ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। এখানে করোনা সংক্রমণের চারটি অস্বাভাবিক ঘটনা সম্পর্কে বলা হলো।

রক্ত জমাট বাঁধতে পারে: অনেক প্রদাহমূলক রোগে রক্ত জমাট বাঁধার বর্ধিত ঝুঁকি রয়েছে। কিছু সংক্রমণেও রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। কিন্তু অন্যান্য সংক্রমণের চেয়ে করোনা সংক্রমণের সঙ্গে রক্ত জমাটের অধিক শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে।

রক্ত জমাটবদ্ধতা যথেষ্ট বড় হলে রক্তনালীর মধ্য দিয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে রক্ত জমাটের কারণে শরীরের যে অংশে রক্ত প্রবাহিত হতে পারছে না তা অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হয়। এটা হার্টে ঘটলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ফুসফুসে ঘটলে পালমোনারি এম্বোলিজম হতে পারে। মস্তিষ্কে ঘটলে স্ট্রোক হতে পারে। সাধারণত বয়স্ক মানুষদের স্ট্রোক হলেও করোনা সংক্রমণে তরুণরাও স্ট্রোকে মারা গেছেন, অথচ তাদের অন্যকোনো রিস্ক ফ্যাক্টর ছিল না।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩০ শতাংশ গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীর রক্ত জমাটবদ্ধতা ছিল। যেসব রোগীকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে রক্ত জমাটবদ্ধতার হার বেশি ছিল। দুশ্চিন্তার খবর হলো, কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে রক্ত পাতলাকারী ওষুধ ব্যবহার করেও রক্ত জমাটবদ্ধতা প্রতিরোধ করা যায়নি।

ঘ্রাণশক্তি হারাতে পারে: এখন আমরা এটাও জানি যে করোনা সংক্রমণে অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের মতো অ্যানোসমিয়াও হতে পারে, অর্থাৎ করোনা রোগী ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারেন। একটি গবেষণা অনুসারে, হাসপাতালে ভর্তিকৃত ৫ শতাংশ কোভিড-১৯ রোগীর অ্যানোসমিয়া ছিল। করোনা সংক্রমণের মৃদু উপসর্গ ছিল এমন অনেক রোগীও জানিয়েছেন তারা হঠাৎ করে ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে অ্যানোসমিয়াকে কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য উপসর্গের তালিকায় সংযোজন করা হয়েছে।

যারা নিয়মিত ঠান্ডায় ভুগেন তারা জানেন যে নাকবদ্ধতার কারণে ঘ্রাণশক্তি প্রভাবিত হয়। কিন্তু সাধারণ ঠান্ডা থেকে কোভিড-১৯ ভিন্ন। কোভিড-১৯ রোগীরা সর্দি অথবা নাকবদ্ধতা ছাড়াই ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে থাকেন। সম্ভবত ভাইরাসটি কোষে প্রবেশের পূর্বে নাকের এসিই২ রিসেপ্টরে অবস্থান করে বলে এমনটা হয়। ঘ্রাণশক্তি হারিয়েছেন এমন কিছু কোভিড-১৯ রোগীর স্বাদ অনুভবের ক্ষমতাও চলে গিয়েছিল।

শিশুরা তীব্র প্রদাহে ভুগতে পারে: শিশুরা অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণের তুলনায় করোনা সংক্রমণে বেশি প্রদাহে ভুগতে পারে। ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকেরা করোনায় আক্রান্ত অনেক শিশুদের মধ্যে তীব্র প্রদাহজনিত সমস্যা দেখেছেন, যেটা ‘মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিন্ড্রোম ইন চিলড্রেন’ (এমআইএস-সি) নামে পরিচিত।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুদের এমআইএস-সি ছিল তাদের পূর্বে কোভিড-১৯ ছিল। এই সমস্যার উপসর্গ শিশুভেদে ভিন্ন হতে পারে। প্রধান প্রধান উপসর্গের মধ্যে জ্বর, ফুসকুড়ি বা ত্বকে লালচে বর্ণ ধারণ, বমি, পেট ব্যথা ও ডায়রিয়া রয়েছে। কিছু শিশুর হার্টে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। এসব উপসর্গের সঙ্গে অন্য কিছু রোগের উপসর্গের মিল রয়েছে, যেমন- কোয়াসাকি ডিজিজ ও টক্সিক শক সিন্ড্রোম। গবেষকরা মনে করেন যে করোনাভাইরাস নিজেই এমআইএস-সি সৃষ্টি করে না, এটা সম্ভবত ভাইরাসটির প্রতি শরীরের ইমিউন রেসপন্সের কারণে হয়ে থাকে।

মানুষ থেকে প্রাণীতে ছড়িয়ে আবার মানুষেতে ছড়াতে পারে: কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে আমরা এটা ধারণা করে এসেছি ভাইরাসটি কোনো প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। শুরুর দিকে আমরা এটাও নিশ্চিত ছিলাম না যে করোনা রোগী থেকে সংক্রমণটি পোষা প্রাণীর মধ্যে ছড়াতে পারে কিনা।

এখন আমরা এটা জানি যে কোভিড-১৯ মানুষ থেকে পোষা প্রাণী বা খাঁচার পশুতেও ছড়াতে পারে, যেমন- কুকুর, বিড়াল ও বাঘ। নেদারল্যান্ডসে কিছু মিনক ফার্মে (মিনক হলো দেখতে বেজির মতো প্রাণী) করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। গবেষকরা ধারণা করেন যে কোনো সংক্রমিত শ্রমিক থেকে ভাইরাসটি এসব ফার্মে ছড়িয়েছে। সংক্রমিত মিনকদের নিউমোনিয়া হয়েছিল। সংক্রমিত মিনক থেকে দুইজন মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটা হলো চীনে ভাইরাসটির উৎপত্তির পর প্রাণী থেকে মানুষেতে কোভিড-১৯ ছড়ানোর প্রথম ডকুমেন্টেড কেস।

তথ্যসূত্র: দ্য কনভারসেশন

 

ঢাকা/ফিরোজ