পূজাসংখ্যা

দুর্গা যখন দানব-দলনী: নজরুলের তিনটি কবিতা

|| মোহাম্মদ আজম ||

নজরুলের প্রিয় চরিত্র ছিল শিব। শিবের তাণ্ডবই নজরুলের কবিতার ভাবগত-রূপগত সবচেয়ে বড় অভিপ্রায়; সে অর্থে শিব নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যনায়ক। অন্তত প্রথম দিকের বিদ্রোহ-বিপ্লবের কাব্যযুগে নজরুল দুর্গারও শরণ নিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। প্রধানত নিপীড়কের শায়েস্তাকারী হিসেবে চিত্রিত সেই রূপে দুর্গা আবির্ভূত হয়েছেন মূর্তিমান ত্রাস হিসেবে। অবশ্য অন্যরূপও যে নেই তা নয়। দুর্গার আগমনের ক্ষণটিকে নজরুল আশা আর আকাঙ্ক্ষার এক মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিরোভাবের ঘটনা তাঁর হাতে বারবার এসেছে বিচ্ছেদ ও বিষণ্নতার প্রতীক হয়ে। আর যে শরতে দুর্গোৎসব সেই শরতের শান্ত-শ্রী, স্বল্পজীবী শিউলীর বিষণ্ন শুভ্রতা তাঁর গৌণ-মুখ্য বহু কবিতার ইমেজের জোগান দিয়েছে। দুর্গাকে কেন্দ্র করে রচিত নজরুলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘আগমনী’। কবিতাটি ১৩২৭ সালের আষাঢ় সংখ্যা ‘উপাসনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সংকলিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’য়। কবিতাটির শুরুতে যুদ্ধক্ষেত্রের রণবাদ্যের অনুসরণ লক্ষণীয় :

একি   রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন-

ঝন   রণরণ রণ ঝনঝন!

সেকি   দমকি’ দমকি’

         ধমকি ধমকি

         দামা-দ্রিমি-দিমি গমকি’ গমকি’ 

ইত্যাদি।

দুর্গার আগমন এভাবে নজরুলের হাতে এক নতুন ইমেজে রূপান্তরিত হলো সেই ব্রিটিশ-কবলিত ভারতবর্ষে। যুদ্ধের দামামায় দুর্গার অভিষেক প্রমাণ করে যে, শত্রু মজুত আছে। আর লড়াইয়ের জন্য দুর্গার প্রস্তুতিতেও বিশেষ বাধা নাই। কারণ, এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেবী বারবার গেছেন। তাতে তাঁর সাফল্যও প্রশ্নাতীত। বস্তুত অসুরবধের কালে দুর্গার যে তেজোদীপ্ত রূপের খবর পুরাণ-মারফত আমরা জানি, নজরুলের এই যুদ্ধ-উদ্দীপ্ত কবিতায় দুর্গার সেই রূপই এক নতুন কালের নতুন প্রয়োজনে পুনরায় নির্মিত হয়েছে। তাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আর ন্যায়ের জয় ঘোষিত হয়েছে।

‘আগমনী’ কবিতায় নজরুল অবশ্য আরো দুটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেছেন। ন্যায়ের যুদ্ধে শরিক সৈনিকদের লাল চিহ্নবাহী হিসেবে সাব্যস্ত করে যুক্ত করেছেন রুশ বিপ্লবের লাল ফৌজকে। অন্যদিকে দানব হিসেবে ব্রিটিশদের চিহ্নিত করলেও এর বিপরীতে ‘সুর’ চাননি, চেয়েছেন মানুষ। এভাবে ‘আগমনী’ হয়ে উঠেছে সেকালের বাস্তব লড়াইয়ের প্রস্তাবনা। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যে সংকলিত হওয়ার আগে ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যায়। এ কবিতায়ও কবি দেবীর দনুজ-দলনী চণ্ডীরূপের ভজনা করেছেন। মায়ের শ্বেতশুভ্র রূপ যতই আকর্ষণীয়া হোক না কেন, আজ তাঁর রক্তমাখা রূপই নজরুলের কাম্য। বাস্তবের নিরিখেই কবির এই আহবান :

রক্তাম্বর পর মা এবার

      জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন;

দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন

      বাজে তরবারি ঝনন-ঝন।

কবিতার মূল রূপকল্পটি সাজানো হয়েছে পৌরাণিক ঘটনার প্রত্যক্ষ ছায়ায়। একদা দেবী তাঁর মায়ামোহিনী রূপ পরিহার করেছিলেন পৃথিবীর মানুষের স্বার্থে। সৃষ্টির সৌন্দর্য আর সামঞ্জস্য রক্ষার স্বার্থে। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল অসুর, দানব বা মহিষাসুর। তখন তাঁকে মোহিনী রূপ ত্যাগ করেই আবির্ভূত হতে হয়েছিল। আর শ্বেতবসন রঞ্জিত করতে হয়েছিল ‘বুক-ডলা-খুনে’। স্পষ্টতই নজরুল পরাধীন ভারতে সেই একই দানবের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। আর যদি তাই হয়, তাহলে দুর্গার আগমন কিছুতেই সাধারণ রূপে ও পরিচয়ে হতে পারে না। যুগের দাবি মেটাতেই তাঁকে পরতে হবে রক্তাম্বর, জালিমের বুকের রক্তে প্রতিষ্ঠিত হবে নতুন দুনিয়ার সূত্র। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে। এ কবিতা চিরকালের মতো বিখ্যাত হয়ে আছে কবির জেলখাটার কারণ হিসাবে। কী আছে এ কবিতায়? কেন ব্রিটিশ সরকার দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে লেখা কবিতায় এত ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল?

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এক দীর্ঘ কবিতা। ভাবের দিক থেকে এবং আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে পূর্বোক্ত কবিতা দুটির সাথে এ কবিতার বিশেষ অমিল নাই। বস্তুত ধূমকেতু পত্রিকার সাথেও আসলে এ আবেগ-অনুভব এক তারে গাঁথা। এ পত্রিকায় নজরুল যেসব গদ্য লিখছিলেন, গদ্য-পদ্য মিলিয়ে গণমানসে যে উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিশ্চয়ই তা আমলে আনছিল। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় তার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল। কবিতাটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও এমন ব্যাপার ছিল, যা নজরুলের আর দশটি একই ধরনের কবিতা থেকে খানিকটা আলাদা। ফলে সরকারের ভীতির কারণ ছিল। মরিয়া তৎপরতার কারণ ঘটেছিল। কবিতাটির তিনটি স্তর। এক স্তরে পৌরাণিক চরিত্র হিসাবে দেবী দুর্গা যেসব বিশিষ্টতার মধ্যে বর্ণিত হন, বিশেষত জালিমের ধ্বংসকারী হিসেবে যেভাবে বন্দিত হন, তার নিপুণ বিন্যাস। দ্বিতীয় স্তরে, সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর চরিত্র, কর্মসূচি, নিপীড়ন ইত্যাদির সালতামামি। তৃতীয় স্তরে, দেবীর আবাহন। তিনটি স্তর আলাদা নয়, বরং পরস্পর-বুননের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক বিবরণীটি সম্পন্ন করেছে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক:

‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি।

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’ এই চার পঙ্‌ক্তিতেই আসলে আমাদের কথিত তিনটি স্তর একাকার হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্গার অস্তিত্ব মাটির মূর্তিতে নয়, বরং পৌরাণিক সময়ের বিভিন্ন পর্বে যেসব কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতেই তাঁর অস্তিত্বের প্রকাশ। অন্যদিকে কবির স্বদেশভূমি যদি স্বর্গ হয়, আর স্বর্গ দখলকারী ব্রিটিশ শক্তি যদি দানব হয়, তাহলে নতুন যুগের এ দানবদের শায়েস্তা করার জন্য তো দুর্গার আগমন জরুরি। কারণ, বাস্তব ঘটনাবলি প্রমাণ করছে, দানবের শাসন চলছে। কয়েদখানা ভর্তি হচ্ছে নিরপরাধ মানুষে। বিনা বিচারে নির্বাসন আর ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়ে উঠেছে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। অন্যদিকে আবার যাঁদের হাতে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের দায়িত্ব, তাঁরাও ব্যর্থ হয়ে বসে আছেন। কবি স্পষ্টতই গান্ধির কথা বলেছেন। অরবিন্দ ঘোষের কথা বলেছেন। এমতাবস্থায় এ জমানায় দেবীর কাজ কী, তাও স্পষ্ট করে বলেছেন। দুর্গার ওই নতুন রূপ অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে ভীত করেছিল, নিপীড়িত মানুষদের জন্য আশ্বাসের কারণ হয়েছিল, বিপ্লবী-বিদ্রোহীদের জন্য নতুন বার্তার বরাভয় এনেছিল। দেবী দুর্গা নজরুলের কবিতায় নতুন ভাবে ও প্রতাপে বৃত হয়েছিলেন। বিপুল মানুষের মধ্যে এই দেবীর যে অমোঘ প্রতিষ্ঠা, তাই নিশ্চয়ই নজরুলকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এই নতুন রূপায়ণে। সেই যাত্রায় পৌরাণিক সিদ্ধির সাথে মিশেছিল নতুন সংগ্রাম, চিরকালীন তাৎপর্যের সাথে মিলেছিল বাস্তবের নিত্যতা। তাতে দেবী দুর্গাকে যেমন নতুনভাবে চেনা হয়েছে, তেমনি চেনা গেছে কবি নজরুলকেও। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৮/তারা