রবীন্দ্রনাথ

সদর স্ট্রিটের বাড়িটাই কি চারুলতার নষ্টনীড় || শাকুর মজিদ

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার লেখা মঞ্চনাটক ‘মহাজনের নাও’ কলকাতায় যায়। আমরা থাকি মধ্যমগ্রামের একটা সরকারি জায়গায়। মধ্যমগ্রামের পর কলকাতার একাডেমি মঞ্চে পরদিন শো হবে। নাটকের দলের ছেলেরা কলকাতা ঘুরতে আসে। আমি বয়সে ওদের সবার চেয়ে বড়। তারা আমাকে নিয়ে ঘুরতে চায়। আমি নিউমার্কেট দেখানোর পর তাদের নিয়ে সদর স্ট্রিটে বেড়াতে আসি। সাংবাদিক মাসুম অপু আর তার স্ত্রী ডেইজী আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা সদর স্ট্রিটের পাশের একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে তক্তার উপর বসে মাটির ভাঁড়ে চা খাই। একসময় অপু আমাকে বলে- দেখেন এইখানেও ঠাকুর আছেন। ফুটপাথের উপর চেয়ে দেখি প্রায় ৩-৪ ফুট উঁচু একটা বেদির উপর রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।কলকাতার অলিতে গলিতে অনেক রকমের আবক্ষ মূর্তি দেখেছি, সেই ১৯৯০ সাল থেকে।সবচেয়ে বেশি দেখেছি ময়দানে। গান্ধী, রামমোহন রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু- এঁদের আবক্ষ মূর্তি দেখেছি বিভিন্ন সড়কে। এই সদর স্ট্রিটের গলির মোড়ে ইন্দিরা গান্ধী, মহাত্মা গান্ধীর আবক্ষ মূর্তি দেখেছি, সে সব মূর্তির গলায় তাজা জবা ফুলের মালা। কিন্তু রবি ঠাকুরের যে মূর্তিটি বানানো হয়েছে, তা খুব নিখুঁত নয়। এর নিচে সাদা মার্বেল পাথরের উপর যে কথাগুলো লিখে রাখা হয়েছে, তার গা থেকে খসে পড়েছে অনেক অক্ষর। তারপরও আমি এই মূর্তিটির কাছে যাই। এবং এর লেখাগুলো পড়ে চমকিত হই। তার বেদিতে লেখা : ‘১০ সদর স্ট্রিটের বাড়িতে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতাটি লিখেছিলেন। ঘটনার স্মরণে তাঁর এই আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। ২৫ বৈশাখ ১৪০৭। রবীন্দ্র স্মৃতিরক্ষা উদযাপন সমিতি।’

যে বাড়িটির সামনের ফুটপাতে এটা রাখা সে বাড়িটি একটি আবাসিক হোটেল। ১৯৯৭ সালে এ হোটেলে আমি থেকেছি সস্ত্রীক। আমার প্রথম ধারণা হয়েছিল, যে হোটেলটিতে এক সময় ৪ রাত থেকেছিলাম সে বাড়িতেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। কিন্তু এই বাড়িটার নম্বর ১০ নয়। খোঁজ নিয়ে দেখি, রাস্তার উল্টা পাশের ৪ তলা বাড়িটাই আসলে ১০ নং সদর স্ট্রিট। নিচতলায় কতগুলো ট্রাভেল এজেন্ট, মানিচেঞ্জার এদের অফিস। উপরে একটা ডেন্টাল ক্লিনিক। দালানের সঙ্গে দালান লাগানো। এ বাড়িতেই কি রবি ঠাকুরের ১২ বছরের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকতেন কাদম্বরীকে নিয়ে? উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতার এই সদর স্ট্রিটের একটা আলোকচিত্র দেখেছিলাম। সামনে চওড়া সড়ক, দু’পাশে কয়েকটি ৩-৪ তলা দালান। এসব দালানের মতোই একটি ছিলো এটি। জোড়াসাঁকো ছিলো উত্তর কলকাতার গ্রামাঞ্চল। সদর স্ট্রিটের এ অঞ্চলটি মধ্যকলকাতার খানদানি এলাকা। এই অঞ্চলকে ঘিরেই তখন তৈরি হচ্ছে আলিশান দালান। তার কিছু পুর্তগিজ, ব্রিটিশ কায়দার, কিছু মোঘল ঘারানার মিশ্রণ। সদর স্ট্রিটের এই পাড়ায় সে সময় এসব সুরম্য অট্টালিকাই উঠেছিল। যদিও কলকাতার ক্লাসিকাল যে দালানগুলো তৈরি হয়েছিল, তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ পাড়ায় আসার প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেই বানানো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সামনে সদর স্ট্রিটের যে বাড়িগুলো দেখছি, তার প্রায় সবই এখন আবাসিক হোটেল হয়ে গেছে। এক সময় এই বাড়িগুলোতে বাস করতেন কলকাতার নব্য বড়লোক বাঙালিরা। এখন এগুলোর মালিক কারা? খুব ভালো তথ্যজরিপ আমার কাছে নেই। তবে আমার অনুমান, এসব দালালগুলো চলে গেছে অ-বাঙালিদের দখলে। কারণ কয়েকটা হোটেলের রিসিপশনে কথা বলে দেখেছি। তারা কেউ কেউ যে বাংলায় কথা বলেন, সেটা বাঙালিদের বাংলা নয়। উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো গ্রামে তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জমিদারি দেখছেন তাঁদের সবচেয়ে বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেঝভাই সত্যেন্দ্রনাথ ভারতের প্রথম বাঙালি সিএসপি হিসেবে বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন আহমেদাবাদে। কলকাতায় এলে থাকেন পার্কস্ট্রিটের একটা ভাড়া বাড়িতে। জোড়াসাঁকোর বাড়িটি নেহাত গ্রামাঞ্চল বলেই হয়তো তখন নতুন জেগে ওঠা অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাস শুরু হয় ঠাকুর বাড়ির লোকজনের। কলকাতায় তখন বাবু সম্প্রদায় বিকশিত। ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি না পেয়েও নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য-ঠিকাদারি পেয়ে অনেকেই ফুলে ফেঁপে উঠছেন। তাঁদেরই কয়েকজন মধ্যকলকাতার এই চৌরঙ্গীর আশেপাশে কিছু প্রাসাদোপম বাগানবাড়ি বানিয়ে ফেলেন। এগুলোতে ভাড়া থাকার মতো ওতো সাধারণ বাঙালি সেসময় ছিলেন না। সেকারণে আরেক জমিদারপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১০ নং সদর স্ট্রিটের এ বাড়িটি ভাডা নেন। এখানে আসার আগে অবশ্য আরো দু’খানা বাড়ি বদল করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নতুনদা। মূলত ‘বাজার সরকার’-এর কালো মেয়ে কাদম্বিনী ওরফে কাদম্বরীকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে অনেকটা একঘরে করে  রাখতেন ঠাকুরবাড়ির ‘আধুনিকা’ মেঝবৌঠান- জ্ঞানদানন্দিনী। এসব ‘ছোটলোক’দের সঙ্গে না থাকার ইচ্ছায় তার আমলা স্বামী এস. এন ঠাকুরকে নিয়ে বির্জিতলার উডস্ট্রিটের বাসায় ভাড়া থাকতেন। জোড়াসাঁকোর এই বাড়ি কাদম্বরীর জন্য অসহনীয় মনে হবার কারণেই হয়তো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বৌকে নিয়ে প্রথমে তেলেনিপাড়ার বাঁড়ুজ্যেদের এবং পরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে গিয়ে ওঠেন। তিনি যেখানেই যেতেন সঙ্গে ছোটভাই রবীন্দ্রনাথও গিয়ে উঠতো এই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ষোলো-সতেরো। কাদম্বরীর আঠারো-উনিশ। গঙাতীরের এই বাগানবাড়িতে বেশিদিন থাকা হয়নি। এক সময় এ ত্রয়ীযুগল পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদেরই বানানো ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটের এ বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, সেখান থেকেই সন্ধ্যাসংগীত আর নষ্টনীড়ের কাহিনি।   রবীন্দ্রনাথের ১২ বছরের বড় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তিনি তখন ব্যস্ত ‘ভারতী’ নামক একটা পত্রিকা প্রকাশের কাজে। মঞ্চ নিয়েও তাঁর ব্যস্ততার শেষ নেই। গান ও নাটকের আড্ডার জন্য তিনি পছন্দ করতেন মেঝবৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িকে। সেখানেই সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি কাটিয়ে দিতেন সময়। নিজে অভিনয় করেন, নাটক লেখেন, আবার বিনোদিনী নামক সেই বিখ্যাত নায়িকার সঙ্গে ভালো ভাব রাখেন। কাদম্বরী দেবীর বয়স তখন কুড়ি। রবীন্দ্রনাথের আঠারো। এরকম বয়সে এই দেবরভাবী এই সদর স্ট্রিটের বাড়িতে সময় কাটাতেন।

জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে এখানে স্বাধীনতা অনেক বেশি বলে কাদম্বরী দেবী এখান থেকে সামান্য দূরে ময়দানে গড়ের মাঠে যেতেন, ঘোড়া চালাতেন। রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে কয়েক মাসের জন্য বিলেতও যান ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য, কিন্তু তার ব্যারিস্টার হওয়া হয়ে ওঠে না। অবশ্য এর আগে ঠাকুর পরিবারের কেউ ব্যারিস্টারি পড়েন নি। পাথুরিয়াঘাটায় বেড়ে ওঠা ঠাকুর পরিবারের আরেক শাখা থেকে তখন একজন ব্যারিস্টার হয়ে এসেছেন। দেবেন ঠাকুর হয়তো সেই চিন্তা থেকে তার সবচেয়ে ছোট ছেলেকে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হলো না। ফেরত এলেন তিনি। ১৮৮৩ সালে বিয়ে করলেন। এবং তার ৪ মাস পর তার প্রিয় খেলার সাথী এবং প্রেম-স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন।    তাহলে সদর স্ট্রিটের এই বাড়িটি কেন তবে নষ্টনীড়ের হোতা? এটা আমার মনে হয়েছে সত্যজিৎ-এর ‘চারুলতা’ ছবিটি দেখে। নষ্টনীড় নামক বড়গল্পটি রবীন্দ্রনাথ লিখেন ১৯০১ সালে। সে বছরই তিনি শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে অভিবাসিত হন। সত্যজিৎ এ নিয়ে ছবি বানিয়েছেন আরো ৬৩ বছর পর। তিনি গল্পের পটভূমি হিসেবে ১৯০১ সালের কলকাতাকে অবজ্ঞা করে ১৮৭৯ সালের কলকাতায় ফেরত গেছেন, ঠিক সে সময়টিতে অথবা তার কিছুদিন পরে জ্যোতিরিন্দ্র কাদম্বরী আর রবীন্দ্রনাথ সদর স্ট্রিটের এই বাড়িটিতে থাকতেন। গল্পে চরিত্রের যে অবস্থান আছে সত্যজিৎ সেখান থেকে কিঞ্চিৎ সরেছেন এবং এ তিন ব্যক্তিচরিত্রের অনেক কাছাকাছি চলে গেছেন। ছবিটির শুরুতে বাইনুকুলার হাতে চারুলতা (মাধবী মুখোপাধ্যায়) তে’তলায় ছাদ থেকে কলকাতার জীবনযাত্রায় যে চিত্র দেখেছেন তা জোড়াসাঁকোর নয়, অনেকটা সদর স্ট্রিটেরই। আর অনেক বেশি মিল দেখিয়ে ফেলেছেন দুই ভাইয়ের বয়সে। রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চেয়ে ১২ বছরের ছোট। সত্যজিৎ-এর অমল তখন ২৩, ভূপতি ৩৫। এটুকু গল্পের কোথাও ছিলো না, এটা সত্যজিৎ-এর রবীন্দ্রায়ন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে সদর স্ট্রিটকালীন জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন কিংবা সে সময় বঙ্কিম, রামমোহন রায় তাঁর স্মৃতিকথায় যেভাবেই এসেছিল, নষ্টনীড়ে তার ইঙ্গিত না থাকলেও চারুলতায় সত্যজিৎ তাই করেছেন। সত্যজিৎ অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ভূপতি আর অমলের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ আর তার নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছাড়া অন্য কিছু নয়। চারুলতার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় শতভাগই নিশ্চিত ছিলেন। না হলে, সত্যজিৎ তার চিত্রনাট্যের স্টোরিবোর্ডে কাদম্বরীর ছবিই বা আঁকবেন কেন? কারণ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘নষ্টনীড়’ লেখেন, তখন খাতার মার্জিনে বেশ কয়েকবার কাদম্বরীর একটা বিশেষ নাম (হেকেটি) তিনি লিখেছিলেন। ১৮৭৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারত থেকে প্রকাশিত সংগীত বিষয়ক প্রথম পত্রিকা বীনাবাদিনী প্রকাশ করেন। আর সত্যজিৎ-এর  চারুলতায় আমরা দেখি, ভূপতি ছাপাচ্ছেন ইংরেজি দৈনিক সেন্তেলিস। গানের প্রতি ভালোবাসা জ্যোতিরিন্দ্রের অনেক বেশি ছিলো। ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গানই তিনি সুর করেছিলেন। ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ যে গানটি সত্যজিৎ চারুলতায় ব্যবহার করেছিলেন সেটাও ছিলো রবীন্দ্রনাথের নতুনদা’র সুর করা। সদর স্ট্রিটের  এই বাড়ির ঘটনাসমূহের প্রায় কুড়ি বছর পর এ নিয়ে গল্প লিখেন রবীন্দ্রনাথ। ততোদিনে তার ভূপতি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গেছেন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর ভূমিকা নানা রকমের। প্রেম ও পূজার যুগপৎ সমন্বয় ছিলো এই নারীর প্রতি, এমন কথা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে, নানা জায়গায়ই লিখেছেন। তাহলে সদ্য-কৈশোর জ্ঞান হওয়া এই বালকের ভেতর প্রকৃতি, নারী উভয়ের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্যই কি তবে ১০ নং সদর স্ট্রিটের এই বাড়িটার কাছে রবীন্দ্র ভক্তের সবচেয়ে বড় ঋণ? রবীন্দ্রনাথ শহুরে কলকাতা তখন তো খুব দেখেননি। নতুন বৌঠানের মৃত্যুর বছর চারেকের মাথায় তিনি চলে আসেন আমাদের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সেখান থেকে রচিত হতে থাকে ‘সোনারতরী’, ‘মানসী’, ‘গল্পগুচ্ছ’ আর ‘ছিন্নপত্র’সমূহ। ১৯০১ সালের পর থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া বাদবাকি প্রধান সময়টা তার কেটেছিল শান্তিনিকেতনে। তাহলে কি শহর কলকাতার রূপ-রস-গন্ধ, যা কিছু তার নেবার ছিলো তার সবটুকুরই সম্বল ছিলো আমাদের এই সদর স্ট্রিট? সদর স্ট্রিটের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথ আবার বিলেত যাওয়ার উদ্যোগ নেন। কলকাতা থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত আসেন এই নষ্টনীড়ের বাড়িতে। এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। রবিকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন তারা। সত্যজিৎ-এর চারুলতায়ও অমলের বিলেত যাওয়া আর তার জন্য পাত্রী দেখার বিষয়গুলো ওখানেও একইভাবে ছিলো। কাদম্বরী বিদূষী মহিলা ছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখার যোগ্য সমালোচকও ছিলেন। কখনো চাইতেন তাঁর কোনো কোনো লেখা একান্তই তাঁর জন্য হবে, পত্রিকায় প্রকাশ করে জনগণের সম্পদে পরিণত হোক এটা কাদম্বরীর চাওয়া ছিলো না। কিন্তু তারপরও রবীন্দ্রনাথ ‘সন্ধ্যাসংগীত’ প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় মানুষটিকে বই উৎসর্গ করেছেন সাংকেতিক ভাষায় ‘হে’ (হেকেটি’র-হে) কে। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কারণে। ১৮৮৩’র ডিসেম্বরে যশোরের ভবতারিণী দেবীকে বিয়ে করে নিয়ে আসা হলো জোড়াসাঁকোয়। ভবতারিণী দেবীকে মৃণালিনী হিসাবে ঘষে মেজে ঠাকুর বাড়ির পরিবেশে অভিযোজিত করার জন্য সদর স্ট্রিটের ঐ বাড়ি ছেড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী চলেও এলেন জোড়াসাঁকোয়। সেই থেকে ঐ বাড়িটি রবিহারা। জীবন স্মৃতিতে কবি লিখেছেন, ‘‘সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-ইস্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ কবিতাটির নির্ঝরের মতই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।’   ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটির কথা আমি যখন শুনি, তখন আমার বয়স ১৭, দশম শ্রেণিতে পড়ি। ক্যাডেট কলেজের আন্তঃহাউজ কবিতা আবৃত্তিতে বাংলায় ছিলো এটি। বহুবার, বহু কষ্টে, রুমে, ক্লাসরুমে শুনতে শুনতে প্রায় সবারই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এ কবিতা যখন প্রথম পড়ি তার কোনো মানে বুঝি না। কিন্তু কী যেনো একটা শিহরণ বোধ মাথার ভেতর দিয়ে খেলা করে যায়। ‘আমি ঢালিব করুণাধারা,আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা। কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব, হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে, এত সাধ আছে, প্রাণ হয়ে আছে ভোর। এসব শব্দমালা যখন কানে এসে লাগতো তখন এক রকমের বিদ্যুৎ খেলে যেতো। আজ সেই কবিতার জন্মস্থানে এসে পুনর্বার সে রকম শিহরণ বোধ করি এবং সন তারিখ হিসাব করে দেখি, যখন তিনি এই কবিতা লিখেন, তখন তার বয়স ছিলো কুড়ি-একুশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কুড়ি বছরের সময়ের সদরস্ট্রিট আর এখানকার সদরস্ট্রিটে অনেক তফাৎ থাকবে এটাই সঙ্গত। তাঁর বাড়ির সামনে যে বৃক্ষরাজির কথা বলা ছিলো, সেই গাছ কাটা গেছে। তেতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখন ফ্রী স্কুল স্ট্রিট দেখার সুযোগ নেই। নতুন নতুন দালান উঠেছিল সম্ভবত সে আমলেই। সদর স্ট্রিটে দু’একটি পুরনো দালান সদর স্ট্রিটে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবাহী এ বাড়িটার বেহাল অবস্থা দেখে আমার মায়া লাগে। আমি ইন্টারনেট খুঁজে বহু পুরনো একটা সংবাদ পাই। ১৭ জুন ২০০৯ সালে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ একটা খবর ছেপেছে। সেখানে গগনদ্বীপ সিং ভালিয়া নামক এক শিখ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবাহী ১০ নং সদর স্ট্রিটের ঠিক উল্টাপাশের ৫এ ও ৫বি দু’টো প্লট কিনে সেখানেই বরীন্দ্রস্মৃতি-কেন্দ্রিক বাণিজ্য পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিনি বলেছিলেন,  নিচতলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্নসমূহ নিয়ে একটা যাদুঘর করতে চান। দোতলায় থাকবে বাঙালি খাবারের দোকান, আর উপরে আবাসিক হোটেল। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করার, পাশাপাশি তিনি বাণিজ্যিকভাবেও সফল হতে চান- এমন কথা বলেছেন ঐ রিপোর্টে। রবীন্দ্রনাথ যে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ নামক অসাধারণ কবিতাটি প্রায় কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে এ বাড়িতে বসে লিখেছিলেন, এমন কথা আমাদের জানা হতো না রাস্তার পার্শ্বে এই আবক্ষ মূর্তিটুকু যদি না দেখা হতো। এই আবক্ষ মূর্তিটি এখানে স্থাপন করার ১৪ বছর অতিক্রম হয়েছে। এখনো ঐ ১০ সদর স্ট্রিটের বাড়িটিতে বরীন্দ্রনাথের কোনো চিহ্ন নাই, এমনকি শিখ বেনিয়া ভালিয়ার প্রতিশ্রুতিরও  ৫ বছর অতিক্রম করে গেছে। সদর স্ট্রিটের ১০ নং বাড়িটার উল্টাপাশের ফুটপাথে এখন এক জীর্ণ আবক্ষ মূর্তির ছাঁচে রবীন্দ্রনাথ ওখানে আছেন। ইন্টারনেটে কেউ যদি হন্যে হয়ে গুগুলসার্চ দিয়ে ১০ নং সদরস্ট্রিট খুঁজে পেতে চান, তিনি পাবেন, ‘রাইজিং স্টার এয়ার বুকিং প্রাইভেট লিমিটেড, ১০, সদর স্ট্রীট। কলকাতা-৭০০০১৬।’ নির্ঝরের স্বপ্নভাঙ্গানো চারুলতায় নষ্টনীড় বলতে এখন ওটাই। আলোকচিত্র : লেখক  

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৫/তাপস রায়