রাইজিংবিডি স্পেশাল

কার অনুমতিতে ধরলা নদীতে পাথর উত্তোলন

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধরলা নদীতে অবাধে পাথর উত্তোলন চলছে। নদীতে ২৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেড় শতাধিক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ‘বোমা মেশিন’ বসিয়ে ৬০-৭০ ফুট মাটির নিচ থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে প্রায় একশ কোটি টাকার সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বড় ধরনের বন্যা, ভূমিধস বা ভূমিকম্পের হুমকিতে রয়েছে।

 

কার অনুমতিতে ধরলা নদীর বুকজুড়ে বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে? এ প্রশ্নই এখন ঘুরে ফিরে পাটগ্রাম উপজেলার সবার মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে।

 

পাটগ্রামের ইউএনও রফিকুল হক বদলি হওয়ার দুইদিন পর হতে ধরলা নদীতে চীন ও ইংল্যান্ডের তৈরি প্রায় দেড় শতাধিক ‘ছয় সিলিন্ডার যুক্ত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা মেশিন’ বসানো হয়েছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে অবৈধপন্থায় পাথর উত্তোলনে কোমর বেঁধে নেমেছেন একশ্রেণির নদী খেকো পাথর ব্যবসায়ী।

 

পাটগ্রাম পৌরসভার মির্জারকোর্ট এলাকা হতে বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ২৮ কিলোমিটার নদী জুড়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এসব বোমা মেশিন বসানো হয়েছে। বলা যায়, ধরলা নদীর বুকজুড়ে এক ধরনের পাথর উত্তোলনের ‘মহাউৎসব’ চলছে। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, জমির মালিক, জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

 

সব ধরনের যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষা করে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

সরজমিনে দেখা গেছে, মির্জারকোট, বাংলাবাড়ী, ব্যাংকান্দা, রাবারড্যাম ব্রিজ, মহিলা কলেজ, মাশানটারী, পেদিরবাড়ী, ধবলসতী, ঝাকুয়াটারী, ডাঙ্গীরপাড়, গুড়িয়াটারী, বুড়িমারী স্থলবন্দর, বুড়িমারী ধরলা সেতু, মাস্টারেরবাড়ী, বুড়িমারী বাঁধেরপাড়, খেংটি, বাদনদল, ষোলঘড়িয়া ও কামারেরহাট এলাকায় চলছে এসব বোমা মেশিন।

 

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিদিন এসব পাথর উত্তোলন মেশিন থেকে পাটগ্রাম থানার ওসির নামে মেশিনপ্রতি পাঁচশ টাকা করে বখরা তোলা হয়।

 

বুড়িমারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাধিক ওয়ার্ড সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থানার দালাল মনোনীত হয়েছেন। এই অভিযোগ থেকে পিছিয়ে নেই বিএনপি-জামায়াতের নেতারাও। অভিযোগ রয়েছে, এ উপজেলায় পাথরের টাকা উত্তোলনের দালাল নিযুক্ত হতে এক প্রকার মৌজা বিকিকিনি হয়। কে হবেন মৌজা অধিপতি তা নিয়ে চলে গোপনীয় হাঁকডাক।

  তেমনি বুড়িমারী, ইসলামপুর, খেংটি এলাকার মৌজা অধিপতি হিসেবে দীর্ঘদিন হতে পুলিশের দালাল নিযুক্ত রয়েছেন জামায়াত নেতা আবু বক্কর। জামায়াত করার অভিযোগ তুলে সেখানেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও বাঁগড়া বসিয়েছেন। কাঁচামালের ব্যবসা ছেড়ে বক্করের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ৯নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি দুলাল হোসেন। এখন হাত ধরাধরি করে পুলিশের নামে বখরা তুলছেন তারা।

 

অপরদিকে ওই ইউনিয়নের বামনদল, ষোলঘড়িয়া ও কামারেরহাট এলাকার পুলিশের বখরা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন জামায়াতের খোলস পরে থাকা বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান ইদু। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ওই ইউনিয়নের বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সহিংসতার সকল মামলারও দেখভাল করেন। আসামি ধরা না ধরা কিংবা চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া তার উপরই নির্ভর করে। এ কথা অকপটে কয়েকজন বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকারও করেছেন।

 

এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও জমির মালিকদের অভিযোগ, অবৈধভাবে ধরলা নদীতে পাথর উত্তোলনের কারণে নদী ভরাট হয়ে গেছে। পাথর আনা-নেওয়ার ট্রলি (ট্রাফে ট্রাক্টর) চলাচলের কারণে স্থানীয় ফাঁড়ি সড়কগুলো সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সড়ক মেরামত করার একমাসও টিকছে না। ফলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকাবাসী।

 

উৎপাদিত শস্য বাজারে আনানেওয়া করতে পারছে না কৃষকরা। অতিরিক্ত পরিবহন খরচ দিয়ে উৎপাদিত শস্য বাজারে আনতে হচ্ছে কৃষকদের। এ ছাড়া পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর দুই ধারের একরের পর একর আবাদি কৃষি জমিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীতে। পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর বুক ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবার বর্ষা মৌসুমে আবাদি জমি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের বন্যায় ভূমিধস বা ভূমিকম্পের কারণে পাটগ্রাম সরকারি কলেজ, সোহাগপুর ধরলা সেতু, রাবারড্যাম সেচপ্রকল্প ও ব্রিজ, দুবেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাউয়ামারী বাজার, বুড়িমারী ধরলা সেতু, বুড়িমারী স্থলবন্দর এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর জিরোপয়েন্ট ধরলা নদীর প্রবেশ মুখে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধটিও চরম হুমকির মুখে রয়েছে। সরকারি এসব স্থাপনা প্রায় শতকোটি টাকারও বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

 

পাটগ্রাম সরকারি জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমন বলেন, ‘আমি নিজেই পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরকুতুবুল আলমকে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরে শুনতে পাই ইউএনও নুর কুতুবুল আলম ও থানার ওসি রেজাউল করিম একই জেলার বাসিন্দা হওয়ায় পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একপ্রকার ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে এসব বোমা মেশিন চালানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই সাধারণ মানুষ কোথাও অভিযোগ করে প্রতিকার পাচ্ছে না। পাথর উত্তোলনের কারণেই সরকারি কলেজ ও রেলওয়ে সঞ্চালন লাইনটিও ধসে যেতে পারে। এখনই এসব বিষয়ে জনগুরুত্ব হিসেবে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মেশিন মালিক জানায়, ‘থানার ওসি রেজাউলের নিয়োজিত দালালকে প্রতিদিন মেশিন প্রতি পাঁচশ টাকার বিনিময়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। বখরার টাকা না দিলে অভিযানের কথা বলে মেশিন বন্ধ করে দেওয়া হয়।’ এলাকা ভিত্তিক আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের দালাল রাখা হয়েছে বলেও জানান ওই মেশিন মালিক।

 

উপজেলার মাশানটারী-পেদিরবাড়ীর এলাকার মেশিন মালিক রফিদুল ইসলাম বলেন, ‘পাটগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম, ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাকী, বিএনপি নেতা বুলবুলসহ বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতাও মেশিন চালাচ্ছেন। তারা যে সিস্টেমের মাধ্যমে চালাচ্ছে আমিও একই সিস্টেমে চালাচ্ছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে মেশিন যাতে কোনো ক্ষতি না হয় এবং র্যা ব বা ডিবি পুলিশ যেন মেশিন মালিককে ধরে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য মেশিন প্রতি পাঁচশ টাকা পুলিশের দালালকে দিতে হয়। এ টাকা প্রতিদিন রাতের মধ্যেই দিতে হয়।’

 

পাটগ্রাম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কোথাও অভিযোগ করে কাজ হচ্ছে না। আগের ইউএনও রফিকুল হকের সময়কালে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। বর্তমান ইউএনও নুরকুতুবুল আলম যোগদান করার দুইদিন পর হতে পুরোদমে পাথর উত্তোলন শুরু হয়েছে। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।’ তবে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের তুলনায় বিএনপি-জামায়াতের দ্বিগুন নেতাকর্মী পাথর উত্তোলন করছেন বলে ওই নেতা দাবী করেন।’

 

পাটগ্রাম উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবু আইয়ুব প্রধান অভিযোগ করে বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে পাথর উত্তোলনকারীদের দমানো যাচ্ছে না। যদি উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় সব শ্রেণিপেশার লোকজনকে একত্র করে জনসচেতনতা গড়ে তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে পারত। কিন্তু প্রশাসনের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। তবে অনতিবিলম্বে পাথর উত্তোলন বন্ধ না করা গেলে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে আশঙ্কা রয়েছে।’

 

পাটগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রেজাউল করিম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এ থানায় যোগদান করার পর থেকেই একটি মহল আমাকে সহ্য করতে পারছে না। এজন্যই এসব মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই মাইকিং করে বরং পাথর উত্তোলনকারীদের হুশিয়ার করা হয়েছে।’

 

পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরকুতুবুল আলম পাথর উত্তোলনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘নতুন যোগদান করেছিমাত্র। পাথর উত্তোলনকারীরা এই সুযোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। পাথর উত্তোলন বন্ধে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার অত্যন্ত আন্তরিক। প্রয়োজনে র‌্যাবের সহযোগিতা নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান আরো জোরদার করা হবে।’

 

পুলিশের নামে টাকা উত্তোলনকারীদের নজরদারীতে রাখা হয়েছে দাবি করে লালমনিরহাট পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে পাথর উত্তোলনকারীদের থামানোর জন্য পাটগ্রাম উপজেলায় গত ১৩ মে থেকে বেশ কয়েকদিন মাইকিং করিয়েছি। এ ছাড়াও পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করেছি। দ্রুত এসব বন্ধ করা না গেলে যেকোনো মুহূর্তে পাটগ্রাম বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।’ বিষয়টি সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।’

 

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পাটগ্রামে নতুন ইউএনও যোগদানের পর পরই আবারও পাথর উত্তোলনকারীরা ধরলা নদীসহ স্থানীয় আবাদি জমিতে মেশিন বসিয়েছে বলে শুনেছি। এগুলো অপসারণ ও মেশিন মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরকুতুবুল আলমকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাথর মেশিন বন্ধে প্রশাসন সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।

       

রাইজিংবিডি/লালমনিরহাট/২৭ মে ২০১৫/মোয়াজ্জেম/সনি