রাইজিংবিডি স্পেশাল

চট্টগ্রামে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম : শীতের শুরু মানেই চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম শুরু। আর মৌসুমের শুরুতে চট্টগ্রামের সাগরতীরবর্তী এলাকাগুলোতে ইতিমধ্যেই শুঁটকি উৎপাদনের ধুম লেগেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর কর্ণফুলী থানা এবং বাকলিয়া থানা এলাকায় কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বড় বড় শুঁটকি পল্লি।

 

এসব পল্লিতে শত শত মাচাং-এ এখনো শুঁকানো হচ্ছে লাখ লাখ টাকা মূল্যের শুঁটকি। শধু চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানা এলাকার কর্ণফুলীর তীরেই ৯৮ একরের বিশাল শুঁটকি পল্লিতে ১২০টি মাচাং-এ শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। সাগর থেকে ফিরে আসা ট্রলার থেকে মাছ সংগ্রহ, মাছ পরিষ্কার এবং এসব মাছ মাচাং-এ প্রাকৃতিক উপায়ে শুঁকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন পর্যন্ত নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে এখানে ব্যস্ত সময় পার করছেন শত শত শ্রমিক। এখন যেন কারো এতটুকু দম ফেলার ফুরসত নেই।

   

সরেজমিনে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার কর্ণফুলীর তীর বাকলিয়া বাস্তুহারা এলাকার শুঁটকি পল্লি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, এখানে সারি সারি শুঁটকি মাচাং-এ নানা প্রজাতির শুঁটকি শুঁকানো হচ্ছে। শত শত শ্রমিক ব্যস্ত রয়েছে এই শুঁটকি শুঁকানো ও নানা প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে। এখানে শুঁকানো হচ্ছে ছুরি মাছের শুঁটকি, লইট্যা, ফাঁইস্যা, চিংড়ি বা ইছা শুঁটকি, ফোঁপা মাছের শুঁটকি, রূপচাঁন্দা, লাক্কাসহ নানা জাতের শুঁটকি। এখানে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে শুঁটকি শুকানোর কাজ। শ্রমিকরাও ব্যস্ত থাকেন ওই সময়টাতে।

 

বাকলিয়া বাস্তুহারা এলাকার শুঁটকি পল্লির শ্রমিকরা জানান, চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় শুঁটকি পল্লি এটি। এখানে ৯৮ একর ভূমিতে ১২০টির বেশি মাচাং-এ শুঁটকি শুঁকানো হয়। প্রায় ১৬ বছর আগে কর্ণফুলী নদীর তীরে মাটি ভরাট হওয়ার পর থেকে বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার এই স্থানে শুঁটকি পল্লি গড়ে উঠে। চট্টগ্রামের সাগরতীরবর্তী কর্ণফুলী, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চরপাথরঘাটা, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখানে শুঁটকি উৎপাদন করছেন।

 

বাকলিয়া শুঁটকি পল্লির শ্রমিক নুরজাহান বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, এখানে প্রতিদিন শত শত কেজি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থেকে শুঁটকি তৈরির জন্য মাচাং-এ শুঁকানো হয়। মাচাং বলতে এখানে শুধু মাছ ঝুলানোর বাঁশের কাঠামোকেই বোঝানো হয়নি। মাচাং মানে একেকটি জমি। যেখানে পৃথক পৃথক মালিকের শুঁটকি শুঁকানো হয়। এখানে মাচাংয়ের পাশাপাশি জমির প্রান্তগুলোতে বাঁশের বড় বড় ফাঁকা দেয়ালে ঝুঁলিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন জাতের সামুদ্রিক মাছ। সাধারণত লম্বা আকৃতির মাছগুলোই ঝুঁলানো হয়। আর ছোটমাছগুলো সমতল জমিতে বিছিয়ে শুঁকাতে দেওয়া হয়। শুঁটকির মাচাংগুলোতে ছুরি, লইট্যা, কদমনী, বাটি, পোপা, চাপা, চামিলা, টেঁকচাঁদ, ইছা, ফেরকিগুলা নামের নানা রকম সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয়।

 

শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখানকার একজন মাচাং মালিক আবদুল সবুর রাইজিংবিডিকে বলেন, চট্টগ্রাম সব সময় ভালো ও সুস্বাদু শুঁটকির জন্য বিখ্যাত। এখানে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। কোনো রকম কীটনাশক ছাড়া শুধু লবণ পানিতে ধুয়ে রোদে শুঁকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। মাচাং-এ শুঁকাতে দিয়ে ৪ থেকে ৫ দিন রাখলে নদীর পাড়ের কড়া রোদেই এগুলো শুঁকিয়ে শুঁটকি হয়ে যায়।

 

শুঁকাতে দেওয়ার আগে কাঁচা মাছগুলোর মধ্যে যেসব মাছ ছোট সেগুলো ধুয়েই রোদে দেওয়া যায়। তবে যেসব মাছ লম্বা যেমন, ছুরি মাছ আর লইট্যা, এগুলো গুন দিতে হয় একটি আরেকটির সঙ্গে (দুইটি মাছের লেজের অংশ একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া, যাতে বাঁশের দড়িতে দুই পাশ থেকে ঝুঁলিয়ে দেওয়া যায়)। এ কাজে সময় বেশি লাগে। শুধু ধোয়া আর গুন দেওয়াতেই সময় বেশি লাগে। মানুষও লাগে বেশি।

   

চট্টগ্রামের বাকলিয়া বাস্তুহারা শুঁটকি পল্লির ১২০টি মাচাং-এ প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার শ্রমিক শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত থাকে বলে এখানকার শুঁটকি উৎপাদনকারীরা জানান।

 

এখানে উৎপাদিত শুঁটকির চাহিদা রয়েছে সারা দেশে। শুঁটকি উৎপাদনের পর প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় শুঁটকির পাইকারী বাজার আসাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টিতে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। চট্টগ্রামের বাকলিয়া শুঁটকি পল্লি থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন ও বিক্রি হয় বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান।রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/২৮ নভেম্বর ২০১৫/রেজাউল/রাসেল পারভেজ