নাসির উদ্দিন চৌধুরী : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ দলের ও বঙ্গবন্ধু নাম ব্যবহার করার হিড়িক লক্ষ্য করা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। নামের আগে-পরে ‘বঙ্গবন্ধু’ অথবা ‘আওয়ামী লীগ’ জুড়ে দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে দুশতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন। এসব সংগঠনের নেই কোন গঠনতন্ত্র, পূর্ণাঙ্গ কমিটি কিংবা নিয়ম নীতি।
এদের তৎপরতা সারাদেশে। একই নামে গড়ে উঠেছে একাধিক সংগঠনও। এসব সংগঠনের নেই কোনো নিবন্ধন কিংবা আওয়ামী লীগের অনুমোদন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিদ্বন্দ্বে একটু নাম ঘুরিয়ে গড়ে তোলা হয় আরেকটি নতুন সংগঠন।
কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এরা ব্যবহার করছে ভিজিটিং কার্ড। এসব ভিজিটিং কার্ড মূলত ব্যবহার করা হচ্ছে চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্যে।
ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর জন্ম হয়। আবার ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এসব সংগঠন হারিয়ে যায় বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
আন্দোলন-সংগ্রামে এদের রাজপথে দেখা না গেলেও ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণে এরাই সবচেয়ে বেশি তৎপর হয়ে যায়। সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নামে সরকারের চিন্তাধারা, আদর্শ, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বেশি তৎপর দেখা যায় এসব সংগঠনের নেতাদের। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও ১৫ আগস্ট উপলক্ষে এদের তৎপরতা বেড়ে যায়।
মন্ত্রী-এমপিদের দিয়ে তদবির করানো, বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতিয়ে নেওয়া, পদক বাণিজ্য, চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে তদবির করা। বর্তমানে এসব অনেকটাই ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের আশীর্বাদ থাকায় এদের দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সহযোগী সংগঠন হচ্ছে- মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, আওয়ামী যুব লীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতি লীগ এবং যুব মহিলা লীগ। আর ভ্রাতৃপতিম সংগঠন হিসাবে শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ।
এই সবুজ ও এম এ করিমের মত আরেক নাম হুমায়ুন করির মিজি। যার রয়েছে ৪-৫টি সংগঠন। তবে তার বঙ্গবন্ধু একাডেমি নামের সংগঠনের নিয়মিত প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। মিজির সংগঠনের মধ্যে অন্যগুলোর নাম হলো- বঙ্গবন্ধু একাডেমী, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, মুজিব হব।
এ ছাড়া নতুন কয়েকটি সংগঠনের নাম জানা যায় যেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিষ্টার জাকির আহমেদ নামের একজন। তার সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, সম্মিলিত তরুন পেশাজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরিষদ। আরেক জনের নাম অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর খান নামের একজনের রয়েছে তিনটি সংগঠন।
বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে অনেক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন- বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু একাডেমী, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমী, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ,বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরামসহ আরো অনেক সংগঠন রয়েছে।
সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, খাদ্য মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সামসুল হক টুকু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ ডজন খানেক আওয়ামী লীগ নেতা এ সব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য নানা ছুঁতায় সেমিনার বা আলোচনা সভার আয়োজন করে নেওয়া হয় আর্থিকসহ নানা সুবিধা।
আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করা সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী যুব আইনজীবী পরিষদ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম।
এ সব সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নানা ইস্যুতে প্রতিদিন সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করছে। মিডিয়া-কাভারেজ প্রাপ্তির কৌশল হিসাবে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত করছে এমপি, মন্ত্রীদের বা দলের কোন প্রভাবশালী নেতাকে।
এগুলোর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, সংগঠনের নেতারা নিজেদের আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক দাবি করে চাঁদাবাজি করে। সচিবালয়সহ অন্যান্য সরকারি অফিসে তদবিরের কাজ করে। টেন্ডারবাজি ছাড়াও নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত তারা।
বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা হন ভাড়া করা। এজন্য ঘুরেফিরে একই লোকদের দেখা যায় প্রায় প্রতিটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে। একই সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের নেতা ও ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা নিয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বা সভাপতিত্ব করানোর অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধু, দেশরত্ন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে গড়ে উঠেছে একাধিক সংগঠন। নিজেদের বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে নানা সুবিধা আদায় করেন বলেও এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ নাম ব্যবহার করতে হলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ (চারটি গ্রুপ), আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান (দুটি গ্রুপ), মুক্তিযোদ্ধা লীগ (দুটি গ্রুপ), মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগসহ আরও বেশকিছু সংগঠন রয়েছে যাদের অনেকেই অনুমোদন না নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
গত বছর মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থক জোট। নামসর্বস্ব ৩৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের আহ্বায়ক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল হক সবুজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, রাজপথে থাকার জন্যই এই জোট করা হয়েছে। তবে অনেক সংগঠনের নেতারা চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, দালাল, তদবিরবাজ, চিটার-বাটপার। তাদের কাজই হচ্ছে এধরনের সংগঠন খুলে এগুলো করে। আমাদের জোটে ৫০টিরও বেশি সংগঠন ছিল এরকম অভিযোগ পাওয়ার কারনে তাদের জোট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের জোটের সদস্য ৩৭টি সংগঠন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কয়েকশ সংগঠন গড়ে উঠেছে যাদের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ বলে আমরা তাদের জোটে নিচ্ছি না। আমাদের কর্মকান্ড হচ্ছে রাজপথ কেন্দ্রিক। তাই আমাদের ও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নাম অক্ষত রাখা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।
জোটের ১৬/অ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তাদের অফিস দাবি করে ৯০ এর দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এই নেতা বলেন, এদের মধ্যে অনেকেই জোটে আসতে চায় কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ থাকার কারনে তাদের আমরা নিচ্ছি না।
এতগুলো সংগঠন চালাতে খরচ কোথায় পান জানতে চাইলে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর হক সবুজ বলেন, কোন খরচ লাগে না, রাজপথে প্রোগ্রাম করলে কোন টাকার দরকার হয় না।
৭৫ এর পর থেকে ঐক্য ন্যাপের নেতা সবুজ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পর ন্যাপ অফিসে নাটকের রিয়ার্সেল করতাম, এর মধ্য দিয়ে ন্যাপের সাথে একটিভ হই। আমি ঐক্য ন্যাপের কেন্দ্রীয় লেবার সেক্রেটারী ছিলাম। ’৯১ এর নির্বাচনের ১৭ দিন পর থেকে আবার আওয়ামী লীগে যোগ দেই। পরে আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা হই।
ভুঁইফোড় এ সব সংগঠনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আমরা এ সব সংগঠনের বিষয়ে সরাসরি বলে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের অনুমোদিত সংগঠন ছাড়া কোন সংগঠন নাই এবং হতে পারে না।
সংগঠনগুলোর বিষয়ে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, যারা এমন অভিযোগ করছে তারা কেন ওদেরকে ধরে পুলিশে দিচ্ছে না। মামলা করে না কেন? কে ওদেরকে সাপোর্ট দিচ্ছে তাহলে সব কিছুই বেরিয়ে আসবে। এখন রাস্তা থেকে কেউ যদি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করে সে দায়িত্ব কি আমাদের নিতে হবে? আমরা কি সেটা জানতে পারছি? আমাদের কাছে এসে কেউ যদি অভিযোগ করে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারি।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জানুয়ারি ২০১৬/নাসির/নওশের