আরিফ সাওন : দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন। কমছে আয়তন। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক হুমকি আর মানবসৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা করছে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এভাবে চলতে থাকলে একসময় এই বন তার অস্তিত্ব হারাবে। তাই এখনই সুন্দরবনের সুরক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোরাকারবারী, বনদস্যু, পশুশিকারী, অসাধু মৎস্য শিকারী, মাছের পোনা ধ্বংসকারী চক্র এবং এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানে বনজ সম্পদ লুণ্ঠনের অসৎ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। অগ্নিকা-, কাঠ পাচারকারীদের দৌরাত্মে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। সিডর ও আইলার মতো ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, ক্লিংকার-তেল-সার-কয়লাবাহী জাহাজডুবি, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সুন্দরবনকে ভয়ানক হুমকির মুখে ফেলেছে।
সুন্দরবন স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরদার শফিকুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে যেসব বন্যপাণী-বৃক্ষরাজি আছে, এরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সহনশীল বলেই দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে। সুন্দরবনকে যেমন প্রাকৃতিক হুমকির মোকাবিলা করেত হয়, তেমনি মানবসৃষ্ট হুমকিও মোকাবিলা করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সুন্দরী গাছ টপ ডাইং রোগে মারা যাচ্ছে। আবার চোরাশিকারী, পাচারকারী ও বন্যদস্যু নির্বিচারে পশু শিকার করছে। বাঘের সংখ্যা কমে ১০৬টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে যদি কমে যায়, তাহলে বাঘ নিয়ে আর আমাদের গর্ব করার কিছুই থাকবে না। তাই সুন্দরবন রক্ষায় এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের মায়ের মতো সুরক্ষা করছে। দক্ষিণ বাংলার বিপুল জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক কর্মকা- এবং মৎস সম্পদ আহরণের উৎস হিসেবে যুগ যুগ ধরে পাশে আছে। পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সুন্দরবন ব্যাপক কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম কেন্দ্র হতে পারে। তাই সুন্দরবনের সুরক্ষার বিকল্প নেই।
সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- অবিলম্বে সুন্দরবন সুরক্ষায় পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। সুন্দরবনের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদুৎকেন্দ্র, জাহাজভাঙা শিল্পসহ কোনো লাল শ্রেণির শিল্প স্থাপন করা যাবে না। শেলা নদী ও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে ঘষিয়াখালী-মংলা চ্যানেল সম্পূর্ণরূপে চালু করতে হবে। চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা খালগুলোর অবৈধ বাঁধ অপসারণ করতে হবে। ক্লিংকার, তেল, সার ও কয়লাবাহী জাহাজডুবির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। নৌপথে টহল জোরদার, অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করে সুন্দরবনের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধে বিশেষ অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সুন্দরবন অঞ্চলের নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য যুগোপযোগী বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ অঞ্চলের যুবকদের বনরক্ষী পদে চাকরিতে নিয়োগ দিতে হবে।
২০০১ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। যদিও এ আয়োজন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
জানা যায়, ১৯১১ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে তা আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার এবং বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ শতাংশ এবং মোট বনাঞ্চলের ৪৪ শতাংশ সুন্দরবন।
আন্তর্জাতিক গুরুত্ব¡ বিবেচনায় সুন্দরবনের অংশ বিশেষকে ১৯৯২ সালের ২১ মে ‘রামসার এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ হল সুন্দরী। এ ছাড়া আছে- গেওয়া, বাইন, কেওড়া, গরান, সিউরা, ওড়া, কাকড়া, ধুন্দল, আমুর, পশুর, গোলপাতা প্রভৃতি। মধু এ বনে প্রকৃতির দান। ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির ভেষজ উপাদান ও সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা হয়। দেশের প্রয়োজনীয় মাছের প্রায় ৫ শতাংশ জোগান দেয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী। এখানকার উল্লেখযোগ্য মাছের মধ্যে রয়েছে- রূপচাঁদা, লইট্যা, ছুরি, মেদ, ইলিশ, পোয়া, কাইন, পাঙ্গাস, ফ্যাসা, ট্যাংরা, ভেটকি, আইড়, ভোল। প্রতিবছর প্রায় ১৫/২০ হাজার টন মাছ আহরিত হয় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে। প্রায় ৩৬ হাজার টন চিংড়ি ও কাকড়া, ৭৫০ টন ইলিশ এবং কয়েক কোটি চিংড়ির পোনা আহরিত হয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদী থেকে। সুন্দরবনে পশু-পাখির মধ্যে আছে- বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণ, শুকর, বানর, সাপ, গুঁইসাপ, কুমির, বনবিড়াল, ভোদরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী।
ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, উজানে নদ-নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় সুন্দরবন অঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততা বাড়ছে। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির পর ওপর থেকে নেমে আসা মিষ্টি পানি প্রবাহ কমে যায়। ফলে বর্তমানে পদ্মার শাখা নদী অধিকাংশ ভরাট হয়ে গেছে। লবন-মিষ্টি পানির সংমিশ্রণের সংকটে সুন্দরবনের প্রকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে সুন্দরবন। সম্প্রতি বনের প্রতিও মানুষ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন আর মানুষের আগ্রাসনে সুন্দরবন যখন হুমকির সম্মুখীন, ঠিক সে সময় বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ উদ্যোগে একটি ও ওরিয়ন গ্রুপ একটি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। যা দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়লাপোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের জীবম-ল ও বায়ুম-লকে দূষিত করবে। সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাস বনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবন অঞ্চলের নদ-নদীর পানি, বায়ু দূষিত হবে এবং হুমকির মুখে পড়বে মানুষের জীবন-জীবিকা।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, এ প্রকল্পে ভারত তার নিজস্ব আইন ভঙ্গ করে কাজ করছে। ভারতের আইন অনুযায়ী, বনের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরণের শিল্প প্রতিষ্ঠান করা যাবে না। অথচ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার ‘বাপার জোন’ থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/রফিক