রাইজিংবিডি স্পেশাল

ধীরে ধীরে কুঠিবাড়ির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে পদ্মা

কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া : ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই’ গানটি মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম কণ্ঠে তুলেছিলেন আজ থেকে কয়েক যুগ আগে।

 

আব্দুল আলীমের গাওয়া গানের সেই সর্বনাশা পদ্মা যেন আজও চির ক্ষুধা নিয়ে বহমান। এপার ভেঙে ওপার গড়াই যেন পদ্মার চরিত্র। বছরের পর বছর এই ভাঙনে অনেক মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা। তবুও যেন থামবার নয় পদ্মা, শেষ হয় না তার ক্ষুধা।

 

এই যেমন পদ্মা এখন কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িসহ কয়েকটি গ্রামের জন্য সর্বনাশা হয়ে উঠেছে। পদ্মার ভাঙনের মুখে বিলীন হতে বসেছে মানুষের সহায় সম্পদ, বসতবাড়ি ও ভিটেমাটি। স্কুল কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অনেক গিলেছে পদ্মা। সামনের দিকে এগিয়ে আসছে ভাঙন।

 

এভাবে এগোতে থাকলে আগামী দুই আড়াই বছরের মধ্যে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়ির।

 

বর্তমানে কুঠিবাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদী। প্রতিবছরই ভাঙতে ভাঙতে কুটিবাড়ির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সম্প্রতি বর্ষা মৌসুমে কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে।

   

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত কুঠিবাড়ির পার্শ্ববর্তী ৯ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। অসংখ্য বসতভিটা আবাদি জমি একে একে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এলাকায় নদী ভাঙনের শিকার হওয়া সাধারণ মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছেন। বসত বাড়ি হারিয়ে প্রায় গাছতলায় এসে দাঁড়িয়েছেন।

 

নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়েছেন কুমারখালীর বাড়াদী গ্রামের সালামত আলী।

 

তিনি বলেন, বাড়ি ঘর সব খেয়ে ফেলেছে নদী। বসতভিটে টুকুও নেই। কোথায় থাকব? কোথায় যাব? কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এক রাতের মধ্যেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। এখন ছেলেমেয়ে, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে পড়েছি বিপদে। নিজে না হয় যেখানে সেখানে চলে যেতে পারছি। কিন্তু ছেলেমেয়েগু্লোর মুখের দিকে তাকিয়ে তো কোথাও যেতে পারছি না।

   

তিনি আফসোস করে বলেন, আমাকে এভাবে ভাসিয়ে না দিয়ে, নিয়ে গেলেই ভালো হত। তাহলে তো আর ছেলে মেয়েদের এমন কষ্ট দেখতে হতো না।

 

একই এলাকার আরেকজন সবুজ শেখ বলেন, থাকার ঘরটা তো নদী গর্ভে চলে গেছে। বাকি আছে শুধু বাড়ির উঠান আর রান্না ঘর। সেটাও যেকোনো সময় নদীর মধ্যে চলে যাবে। রাতে ভয়টা বেশি করে, কখন জানি নদী গর্ভে চলে যাই।

 

শুধু বাড়াদী গ্রামেই এ অবস্থা নয়। কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কালোয়া এবং বেড়কালোয়া গ্রামের চিত্রও প্রায় একই।

 

এলাকার হাজারো মানুষ যেকোনো সময় সহায় সম্বলহীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে এসব এলাকার অনেকেরই বসতভিটে, আবাদি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে।  পদ্মার ভাঙনে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ, রাস্তা-ঘাট, গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

   

পদ্মার ভাঙন এভাবে চলতে থাকলে একদিন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজ হাতে তৈরি হাসপাতাল, কাচারিবাড়িসহ কুঠিবাড়িও।

 

কুমারখালী পাবলিক লাইব্রেরির ডেভেলপমেন্ট সেক্রেটারি হাবীব চৌহান জানান, আসলে পদ্মার রুপরেখা বোঝা খুবই মুশকিল। এটি স্বভাবতই এক পাড় ভাঙে আর আরেক পাড় গড়ে। তবে এটি এখন শিলাইদহের দিকে ভাঙতে শুরু করেছে। ভাঙন বেশি হলে দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ধরে ফেলবে নদী।

 

এ ব্যাপারে কুমারখালী শিলাইদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন ইসলাম খাঁন তারেক বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই পদ্মা নদীর পানি বেড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা ভাঙতে শুরু করেছে। এ ভাঙন রোধ না করলে কুঠিবাড়ি হুমকির মুখে পড়বে। গত কয়েকদিনে প্রায় শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। মানুষজন অসহায় হয়ে পড়েছে।

 

তিনি আরো বলেন, যদি পদ্মার ভাঙন এভাবে চলতে থাকে কিছুদিনের মধ্যেই এই এলাকাসহ বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নির্দেশনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারিবাড়ি, তার নিজের হাতের তৈরি হাসপাতালসহ কুঠিবাড়ি।

 

তিনি বলেন, পদ্মার এ ভাঙন রোধ করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে।

   

কয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম স্বপন বলেন, ভাঙনে এই এলাকার অনেক বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। বেশ কিছু রাস্তাও এখন হুমকির মুখে। যেকোনো সময় এগুলো বিলীন হতে পারে। খুব দ্রুত যদি এ সমস্যার সমাধান করা না যায় তাহলে সামনে আরো বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে কয়েকটি গ্রামসহ শিলাইদহের কুঠিবাড়ি।

 

এ ব্যাপারে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেলা আক্তার বলেন, নদী ভাঙনের এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। ইতোমধ্যে সেখানে ভাঙন রোধ করার জন্য বালির বস্তা দেওয়া হয়েছে।

 

জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, শিলাইদহের কুঠিবাড়ি রক্ষাসহ যে স্থানগুলোতে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। সেখানে ভাঙন রোধে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া যাদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

 

কুষ্টিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নৈমূল হক বলেন, বর্তমানে কুঠিবাড়ি থেকে পদ্মা নদী প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ভাঙতে ভাঙতে এতো কাছে চলে এসেছে। তাই কুঠিবাড়ি রক্ষায় ও পার্শ্ববর্তী এলাকা সংরক্ষণের জন্য ‘পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আওতাধীন ৩ দশমিক ৭২০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণের জন্য ১৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার বরাদ্দ হয়েছে। খুব শিগগিরই এর কাজ শুরু হবে।

   

রাইজিংবিডি/কুষ্টিয়া/২৪ জুলাই ২০১৬/কাঞ্চন কুমার/রুহুল