রাইজিংবিডি স্পেশাল

জাতীয় ঐক্যে জামায়াত প্রশ্নে কৌশলী বিএনপি

এস কে রেজা পারভেজ : জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে পেতে জোটের সবচেয়ে পুরোনো মিত্র জামায়াত ইসলামী প্রশ্নে কিছুটা কৌশল পাল্টাচ্ছে বিএনপি। বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য মেলানোর প্রয়োজনে জামায়াতকে সাইডবেঞ্চে রাখছে দলটি।

 

একযুগের বেশি সময় ধরে বিএনপির প্রধান মিত্র এই দলটির সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কচ্ছেদ হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগে জামায়াত থাকছে না। তবে একেবারেই জোট থেকে জামায়াতকে বের করে দেওয়া হচ্ছে কী না- সে সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে।

 

যেমনটি বলছিলেন খালেদা জিয়ার পরামর্শক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘জামায়াতকে জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়ায় রাখা হচ্ছে না। নীতিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ তবে জোট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে কী না- সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।

 

জামায়াতকে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, না কী শুধু জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে সাইড বেঞ্চে রাখা হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আরেক পরামর্শক এবং বিএনপির জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তা বলতে পারবো না। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, জোট কি ছিলো কখনো? জোট তো নামেই ছিলো। তাদের তো মাসেও একটি মিটিং হতো না। বিএনপিও জোটকে সিরিয়াস কিছু হিসেবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তবে জাতীয় ঐক্যে জামায়াত থাকছে না।’

 

মুলত খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যে জামায়াত প্রশ্নে অন্যান্য দলগুলোর আপত্তির মুখে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপি। যদিও ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের মাঝে যে, জামায়াত ছেড়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়লে কি পাবে বিএনপি? তাছাড়া জামায়াতকে ছেড়ে দিলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্য গড়ে তুলবে, এর কি গ্যারান্টি আছে?

 

গত এক যুগেরও বেশি সময়ের মিত্র জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটিই এখন রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। কারণ, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অনেক নিবিড়, বিশেষ করে রাজনৈতিক উত্থান-পতন আর ক্ষমতার ভাগাভাগিতে।

 

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যায় জামায়াত। স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে ওই জোটগঠন নিয়ে সমালোচনায় পড়লেও বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তা কার্যকর প্রমাণ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করে দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়েই ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট। লাভবান হয় জামায়াত। ওই নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭টি। তখন দুই ‘আলবদর’ নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে নিন্দিতও হয়েছিলো বিএনপি।

 

এরপর থেকেই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপিকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে জামায়াত। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। পরে জোট রূপ নেয় ২০ দলে। এই জোটে অন্য দলগুলো নামসর্বস্ব হওয়ার কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের ওপর দিনে দিনে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বিএনপি। নির্বাচনের পূর্বাপর যেসব আন্দোলন হয়েছে সেখানে বিএনপির নামে মাত্র অংশগ্রহণ থাকলেও জামায়াতের ভূমিকা ছিলো যথেষ্ট বেশি।

 

জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া এগিতে নিতে গত ১৪ জুলাই রাজধানীর গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া। যেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ।

 

ওই বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে জামায়াতকে ছাড়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে বলেন তারা। যদিও এর বিপরীতে তখন খালেদা জিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বিএনপির জাতীয় ঐক্যের সূত্র ধরে গত কয়েকদিনে ডা. জাফরুল্লাহ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, গণফোরাম ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইসব বৈঠকে জাতীয় ঐক্যের আলোচনায় আসতে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত দেন দলগুলোর নেতারা।

 

জানতে চাইলে মঙ্গলবার দুপুরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সকল দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য দরকার। জাতীয় ঐক্য প্রধানমন্ত্রীই ডাকতে পারেন। কিন্তু তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ডাকবেন না বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে, আগস্ট মাসেই আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে। মানে, আমরা সংকট মুক্ত হইনি এখনো।’

 

‘এই ক্ষেত্রে সমস্ত জাতির একজায়গায় আসা উচিত। বিএনপি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে চায়। আগে একটি প্রতিবন্ধকতা ছিলো জামায়াত নিয়ে। এখন তো বিএনপি জামায়াত ছাড়াই বসবে সবাইকে নিয়ে। অন্ততঃপক্ষে একটি ঝামেলা তো কমেছে, বলেন তিনি।

 

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তি হিসেবে এবং নাগরিক ভাবনা থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

 

‘আমি জানতে চেয়েছি, তারা কে কি চিন্তা করছে। আমি কিন্তু কারো পক্ষ হয়ে যাইনি। সত্যিকার অর্থেই আমার নিজের পক্ষ থেকে, একটি নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকেই এসব কিছু করেছি। ব্যক্তি হিসেবে বোঝার জন্য, দেশের এই সংকটের কারণ ও এর প্রতিকার- এসব বিষয় উপলব্ধি করার জন্য এবং আমার নিজের জ্ঞানের জন্যই সবার সঙ্গে কথা বলেছি’, বলেন ডা. জাফরুল্লাহ।

 

তবে খালেদা জিয়ার ডাকা জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন বিএনপির নেতারা। তাদের মতে, সরকার বিএনপির জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য অর্থ পাচার মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছে। তবে সেই পাঁদে পা দেবে না বিএনপি।

 

তারা বলছেন, শত ইস্যু তৈরি করেও বিএনপির জাতীয় ঐক্য থেকে গতি ভিন্ন দিকে ফেরানো যাবে না। সেজন্য তারেক রহমানকে সাজা দেওয়ার পরও কঠোর কোনো আন্দোলনে যায়নি দলটি। মুলত কঠোর কর্মসূচিতে গেলেই জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়বে বিএনপি। এই ধারনা থেকেই শুধু বিক্ষোভ কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে দলটি। আর তারেক রহমান বিদেশে থাকায় এ নিয়ে আপাতত কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তায়ও নেই দলটির।

 

বিএনপি সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যে জামায়াতকে পেছনে রেখে অন্য দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে গেলে বিএনপি কী পাচ্ছে শেষ মুহূর্তে এসে এটি নিয়ে বিশ্লেøষন চলছে। সিদ্ধান্ত শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন তার গুলশানের বাসভবনে চা চক্রে নেতাদেরকে আমন্ত্রণ জানাবেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, সিপিবি-বাসদসহ দলগুলোর নেতাদেরকে চা চক্রে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

 

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের অগ্রগতি জানতে চাইলে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে দু’একদিনের মধ্যেই দুই জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য আমন্ত্রন জানানো হবে। এই সপ্তাহে না হলেও পরের সপ্তাহে অবশ্যই হবে।

 

আমরা খালেদা জিয়াকে এই পরামর্শ দিয়েছি যে, নিজেরা সংগঠিত হয়ে জামায়াত বাদে অন্য যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, রব; উনাদের একত্রিত করে সুসংগঠিত হওয়া যেতে পারে। পরে তারা একসঙ্গে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। আওয়ামী লীগ সেটি গ্রহন করুক বা না করুক সমস্যা নেই। কিন্তু যেহেতু এটি জাতীয় ইস্যু। সেজন্য পরবর্তী সময়েও আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগকে আমন্ত্রন জানানো হবে।’

 

জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে জানিয়ে এমাজউদ্দিন বলেন, ‘সবাইকে ইতিবাচক দেখা গেছে। এখন আলোচনা করে তাদের চিন্তা-ভাবনা, মতামত, পরামর্শ শুনে পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হবে।’

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুলাই ২০১৬/রেজা/শাহনেওয়াজ