রাইজিংবিডি স্পেশাল

এক যুগেও শেষ হয়নি বিচার

এমএ খান : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানোর এক যুগ পূর্ণ হলো আজ। ১২ বছরেও মামলার বিচার শেষ হয়নি। মামলায় অভিযুক্ত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৮ আসামি এখনো পলাতক।২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় তৎকালীন এসআই ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃথক তিনটি মামলা করেন। এরপর আওয়ামী লীগের কর্মী বদর আজিজ খালেদা জিয়া-তারেক রহমানসহ বিএনপির কয়েক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। তবে এ চার মামলার মধ্যে দুটিতে চার্জশিট দেওয়া হয়।চার্জশিটের ৪৯১ জন সাক্ষির মধ্যে ২২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ২২৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষী দিচ্ছেন প্রথম চার্জশিট দাখিলকারী তদন্ত কর্মকর্র্তা সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর।ফজলুল কবীর গত ১ জুন থেকে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন। চলতি মাসে এ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হতে পারে। সম্পূরক চার্জশিট দাখিলকারী তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ সাক্ষ্য দেবেন। রাষ্ট্রপক্ষ আর কোনো সাক্ষী না দিলে এরপর আত্মপক্ষ শুনানি এবং শেষে হবে যুক্তিতর্ক। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল সূত্র বলছে, ২১ আগস্ট মামলাটির এক যুগপূর্তি হলেও কার্যক্রম শেষ ও রায় ঘোষণার জন্য আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।পুুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটির কার্যক্রম চলে। বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দিন এ মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মামলা দুটিতে আগামী ২২ ও ২৩ আগস্ট পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলী বিশেষ পিপি সৈয়দ রেজাউর রহমান জানান, দীর্ঘ দিনেও বিচার শেষ না হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম তদন্তকালে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে মামলাটি বিপথে নেওয়ার চেষ্টা। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস, মজুদ, সংগ্রহ ও বিতরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে চার্জশিটে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকায় সে ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত করতে হয়। দুই দফা তদন্তে ছয় বছর সময় লাগে। এরপর ২০১২ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় দফায় চার্জ গঠন করা হয়। প্রথম চার্জশিটে আসামি ছিল ২২ জন। অধিকতর তদন্তে আরও ৩০ জন যুক্ত হয়ে মোট আসামি হয়েছে ৫২ জন।  অন্যদিকে আসামিপক্ষ বিচার বিলম্বের জন্য কয়েক দফা উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। এ বছরের মধ্যেই মামলা দুটির বিচার এবং নিষ্পত্তি হবে।বিচার শেষ হবে কবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তাই নির্দিষ্ট করে মামলার বিচার কবে শেষ হবে বলা সম্ভব নয়।’মামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষ্য নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যাদের প্রয়োজন তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এবং হবে।’মামলার আসামি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মামলা দুটির বিচার শেষ করতে তড়িঘড়ি করছেন। তারা তড়িঘড়ি করে বিচার শেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের সাজা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী আব্দুর রশীদ মোল্লা বলেন, ‘বর্তমান সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণেই মূলত বিচারে এ দীর্ঘ সময় লেগেছে। নতুন করে মামলা তদন্তে নেওয়ায় মামলার বিচার কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যের বাইরেও কিছু বক্তব্য রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছে। আর সে কারণেই জেরায় বেশি সময় লাগছে। যেমন : সাক্ষীদের রাজনৈতিক বক্তব্য শিখিয়ে আনতে গেলে সময় বেশি লেগে যায়, আর সেই কারণে সাক্ষীদের জেরা করতেও বেশি সময় লেগে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ মামলায় প্রথম অভিযোগ গঠনের পর ৬১ জনের সাক্ষী নেওয়া হয়। পরবর্তীতে অধিকতর তদন্তে যেসব আসামি যুক্ত করা হয়েছে তারা সবাই বিএনপির নেতা। ২০০৮ সালের ১১ জুন তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। এরপর বিচারে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল।এরপর ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১১ সালের ৩ জুলাই অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ আরো ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি।২০১২ সালের ১৮ মার্চ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সম্পূরক চার্জশিটের ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। মামলাটিতে খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, প্রাক্তন আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা- প্রাক্তন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ ও প্রাক্তন ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে আছেন।প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রাক্তন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ আসামি কারাগারে আছেন। আরেক আসামি প্রাক্তন মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৮ আসামি পলাতক আছেন। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।  ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ। প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হন কয়েক শ নেতাকর্মী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি কমে গেছে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৬/মামুন খান/তৈয়বুর রহমান/রফিক