রাইজিংবিডি স্পেশাল

দুঃসময় পিছু ছাড়ছে না বিএনপির

এস কে রেজা পারভেজ : প্রায় এক দশক আগে ক্ষমতা হারানো বিএনপি সুসময়ের দেখা তো পাচ্ছেই না, উল্টো সময়ের সঙ্গে নতুন নতুনভাবে হোঁচট খাচ্ছে। সংকটের পর সংকটের মিশেলে দলটির দুঃসময় যেন কাটতেই চাইছে না।

 

কখনো আন্দোলনে ব্যর্থ, কখনো দলের অভ্যন্তরীন বিভেদে টালমাটাল অবস্থা, আবার কখনো মামলায় শীর্ষ নেতাদের কারাবরন-সংকটের ধারাবাহিক চিত্র। প্রকৃতিও যেন দলটির সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করছে। সবধরনের সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মৃত্যু। একের পর এক শোকের বার্তায় মুহ্যমান হচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

 

মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ যোগ হয়েছে আরো একটি নাম, তিনি হান্নান শাহ। গত মঙ্গলবার চিরবিদায় নিয়েছেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। সিঙ্গাপুরের রাফেলস হার্ট সেন্টারে সেখানকার স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।

 

দলের এই নেতাকে বলা হতো ‘বিপদের কান্ডারি’। এক এগারোতে যখন পুরো রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছে, দলগুলোতে শুরু হয়েছে ভাঙা গড়ার খেলা। তখন বিএনপিতে সাহসী মানুষগুলোর মধ্যে উপরের দিকে যার নাম উঠে আসে, তিনি হান্নান শাহ।

 

এক- এগারোতে দলের ক্রান্তিকালে হান্নান শাহ দলের ঐক্য ধরে রাখতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলের সংষ্কারপন্থী একটি অংশের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সাহসী কথাবার্তা বলে চাঙা রাখেন দলকে। আপোষহীণ নেতৃত্ব তাকে খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত নেতার স্বীকৃতি দেয়। 

 

কঠিন সময়ে তৃনমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে এবং দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে অবদান রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও নেতাকর্মীদের নজর কাড়েন তিনি। এর পুরস্কারও পান হান্নান শাহ। ২০০৯ সালে দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে আসম হান্নান শাহ সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

 

দলের বর্তমান কঠিন সময়ে তার মতো একজন ‘প্রতিশ্রুতিশীল’ নীতিনির্ধারকের মৃত্যুতে অপূরনীয় ক্ষতি হলো বলে মনে করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, এই নেতা মৃত্যুবরণ করায় আন্দোলন সংগ্রামের একজন বীরকে হারালো বিএনপি।

 

হান্নান শাহের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না, তিনি সত্যিকার অর্থে একজন গণতন্ত্রের সৈনিক ছিলেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।

 

বিশেষ করে বিএনপি ও বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সংকটে পড়েছিল ১/১১-এর অবৈধ সরকারের সময়ে; বিএনপির পক্ষে, বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন হান্নান শাহ। আমরা তার জন্য দোয়া চাই।’

 

বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহের মৃত্যু সংবাদ তার কাছে ‘অকল্পনীয়’ জানিয়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এটা যে কতবড় দুঃসংবাদ তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এ বেদনা ও শোকের পরিমাপ নেই।’

 

তিনি বলেন, ‘জাতীয় জীবনে বর্তমান ক্রান্তির সময়ে তাকে যখন খুব দরকার, সে সময় তিনি চিরতরে চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে বিএনপিই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশ হারালো জাতীয় স্বার্থরক্ষার এক দেশপ্রেমিক অধিনায়ককে, জাতি হারালো তার এক সাহসী সন্তানকে। এ ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়।’

 

১৯৮৩ সালে বিএডিসির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন হান্নান শাহ। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে হান্নান শাহ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) এবং ১৯৯৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

২০০৯ সালে দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে আসম হান্নান শাহ সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ষষ্ঠ কাউন্সিলেও তিনি এই পদে পূন:নির্বাচিত হন। হান্নান শাহ গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকারে থাকাকালীন খালেদা জিয়ার সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

 

ফজলুর রহমান পটল গত ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান পটল। কলকাতায় রবীন্দ্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান প্রাক্তন এ প্রতিমন্ত্রী।

 

রাকসুর প্রাক্তন ভিপি ফজলুর রহমান পটল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বিএনপির প্রচার সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ফজলুর রহমান পটল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। বর্তমান কমিটিতেও একই পদে বহাল ছিলেন তিনি।

 

আর এ গনি চলতি বছরের শুরুতে দলের তৎকালীন নীতি নির্ধারক আর এ গনিকে হারানোর দু:সংবাদ শোনেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তিনি দলের আগের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন।

 

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

 

জিয়াউর রহমানের সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী গনির বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গনিকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে ৭ জানুয়ারি তাকে সেখান থেকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন রাত থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।

 

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। তিনি বিএনপির আগের কমিটির প্রভাবশালী নীতি নির্ধারক ছিলেন।

 

গত বছরের ২১ নভেম্বর দিবাগত রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চতুর্থ ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকর হয়। কোন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আর কাউকে  এ দেশে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হয়নি। এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী।

 

নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু গত বছরের ৩ মে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মারা যান। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়।

 

ছাত্রদলের প্রাক্তন সভাপতি ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন পিন্টু পিলখানা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। এ ছাড়া একটি অস্ত্র লুটের দায়ে তাঁর ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।

 

হাবিব উন নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পিন্টু। পরে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পান। ছাত্রদলের সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের নির্বাচনে ঢাকার লালবাগ-কামরাঙ্গীরচর চর আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। গত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

 

আরাফাত রহমান কোকো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আন্দোলনের দাবিতে বিএনপির দ্বিতীয় দফায় সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি শোনেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেই সংবাদে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মাঝে নেমে আসে চরম শোকের ছায়া।

 

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরন করেন। ২৭ জানুয়ারি তার লাশ দেশে আনা হলে নেতাকর্মীরা বিষাদে ভেঙে পড়েন।

 

দলের নীতি নীর্ধারনী পর্যায়ের শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব মৃত্যুর বিষয়ে শোক প্রকাশ করে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই শোকের। মৃত্যু সংবাদ যেমন বেদনার, তেমনি মানতেও কষ্ট হয়।’  

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬/রেজা/শাহনেওয়াজ