রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘ব্লু হোয়েল’ প্রযুক্তির চরম অভিশাপ

আবু বকর ইয়মিন: বাংলাদেশে নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক মরণঘাতি গেমস ‘ব্লু হোয়েল’। সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ার ভাইরাল হয়ে উঠেছে এ গেমটি। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা এ খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে অভিভাবকদের মাঝে। বিষয়টিকে প্রযুক্তির চরম অভিশাপ বলে উল্লেখ করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির যেমন ভাল দিক আছে তেমনি খারাপ দিকও রয়েছে। এটি প্রযুক্তির খারাপ দিকের চরম পর্যায়। মূলত কম বয়সী ছেলে মেয়েরা অতিরিক্ত কৌতুহল থেকে এসব দিকে ঝুঁকে পড়ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, একাকিত্ব ও বাবা-মায়ের অসচেতনতা এর জন্য বড় দায়ী। সম্প্রতি রাজধানীতে অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা (১৩) নামের এক তরুণির আত্মহত্যার খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। সর্বশেষ ব্লু হোয়েলে আসক্ত দুই কিশোরের খোঁজ মিলেছে বলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়। এর আগে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর এই গেমের বলি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী। গত দু’মাস ধরে ভারতজুড়ে চলছে ব্লু হোয়েল আতঙ্ক। এই গেমের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। আর গেমে প্রবেশ করে তারা বিবেকহীন হয়ে পড়ে। এটা মাদকাসক্তের চেয়ে ভয়ঙ্কর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, এটা ইন্টারনেটে একটা অভিশাপ। টেকনোলজির নতুন নতুন আবিষ্কার সমাজের কল্যাণের পাশাপাশি অকল্যাণেরও বার্তা দেয়। ব্লু হোয়েল খেলা তারই একটি ফল। এ গেমকে অত্যাধিক আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। এটা এতটাই আকর্ষণীয় যে, এক স্টেপের পর আরেক স্টেপে যেতে ছেলেমেয়েরা অস্থির হয়ে পড়ে। একটা পর্যায়ে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এর হাত থেকে শিশু কিশোরদের রক্ষার  উপায় হিসেবে প্রবীণ এ মনোবিজ্ঞানী, সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণকারীদের নজরদারি বাড়ানো, এসব গেমের উত্স বন্ধ করা এবং ছোটকাল থেকেই সন্তানের সব বিষয় বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করার সুযোগ করে দেওয়া, প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন হওয়ার কথা বলেন। অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি সমাজে আমরা বাস করছি। এ পরিবর্তনের মাঝে এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় অনেক কিছুই আমাদের সমাজে ঢুকে পড়ছে। ব্লু হোয়েল তারই একটি ফল। যারা মানসিক ভাবে সুস্থ্য নয় তারা তরুণদের কাছে এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ছুড়ে দেয়। আর তরুণরা এই গেমের একটা স্টেপ পার করাকে অর্জন হিসেবে নেয়। নবাগত অনেক বিষয় আমাদের সামাজিক অনুশাসনের সাথে খাপ খাচ্ছে না। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে স্কুলিং, কাউন্সেলিং, কমিউনিটি পর্যায়ে কার্যক্রম বাড়াতে হবে। আর সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিভাবকদের সচেতনতা। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানি অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল জানান, অনেক কিশোর-শিশোরী এখন এই গেমে আসক্ত হচ্ছে। গেমটি তাদের এক পর্যায়ে বিবেকহীন করে ফেলে। তখনই আস্তে আস্তে তাদের আত্মহননের পথে নিয়ে যায়। কিশোর-কিশোরীরা বিষয়টি বুঝতে পারে না। মুহিত কামাল তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জিত তরুণ সমাজকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি মরণঘাতির এই লিঙ্কটি বাংলাদেশে যাতে অকার্যকর থাকে সেব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বিটিআরসির প্রতি আহ্বান জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নতুন আতঙ্ক ব্লু হোয়েল গেমের ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তারা তদন্ত প্রতিবেদন দিলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০১৩ সালে রাশিয়ায় শুরু হয় এই মরণ খেলা। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে দু’বছর পরে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, নীল তিমিরা মারা যাওয়ার আগে জল ছেড়ে ডাঙায় ওঠে৷ যেন আত্মহত্যার জন্যই। সেই থেকেই এই গেমের নাম হয়েছে ‘ব্লু হোয়েল’ বা নীল তিমি৷ রাশিয়ার মনোবিজ্ঞানের আকে ছাত্র এই খেলার আবিষ্কারক। ইদানীং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার ঘটনায় নাম ছড়িয়েছে ‘ব্লু হোয়েল গেম'-এর৷ হু হু করে বাড়ছে আত্মহননের ঘটনা। সাইবেরিয়ার দুই স্কুলছাত্রী য়ুলিয়া কনস্তান্তিনোভা (১৫) এবং ভেরোনিকা ভলকোভা (১৪) একটি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ তদন্তে নেমে পুলিশের নজরে আসে এই ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’৷ ভারতে গত দু’মাস ধরে ব্লু হোয়েল নিয়ে চলছে শোরগোল। স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ব্লু হোয়েল লিংক সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের সরকার। পাশাপাশি এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। ব্লু হোয়েলে আসক্তদের চিহ্নিত করা যাবে যেভাবে

যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদেরকে সব সময় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। অনেকটা অস্বাভাবিক আচারণ করে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় স্যোশাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনো আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা। এদিকে ‘ব্লু হোয়েল গেম’ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেন ছেলে-মেয়েরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইলে বেশি সময় দিচ্ছে, অনেক অভিভাবকের সেদিকে তাকানোর সময় নেই৷ ফলে বিপদ তাঁদের নজর এড়িয়ে ঘরে ঢুকছে৷ বাবা-মায়েদের তাঁদের সন্তানদের আরও বেশি সময় দেওয়াই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান৷ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগও তাদের ফেসবুক পেজে ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে সতর্ক করে বলেছে, অনলাইনে ব্লু হোয়েল গেম খেলা বা এই গেমের লিঙ্ক দেওয়া-নেওয়া বা সে চেষ্টা দন্ডনীয়। যারা এগুলোর যে কোনো একটি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাইবার পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৭/ইয়ামিন/হাসান/এনএ