রাইজিংবিডি স্পেশাল

বিজয় দিবস উদযাপনে থাকবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী আহ্বান

হাসান মাহামুদ : শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস। আর কয়েকদিন পরেই ৪৬তম মহান বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে জাতি। এরইমধ্যে ‘মহান বিজয় দিবস-২০১৭’ উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে সরকার। কর্মসূচিতে থাকছে নতুনত্ব, আওতাও হবে বিশাল। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে এবারের বিজয় দিবসে থাকবে আলোচনা সভা, মোনাজাত ও প্রার্থনা। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘মহান বিজয় দিবস-২০১৭’ উদযাপনের জাতীয় কর্মসূচিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবস উদযাপনের সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পন করবেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সকালে তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিএনসিসি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড ও কারারক্ষীর সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এ সময় বিমান বাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট হবে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কিত যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বিকেলে বঙ্গভবনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হবে। এদিন সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকাসহ বিভিন্ন পতাকায় সজ্জিত করা হবে। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। সব জেলা ও উপজেলায় এবং বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসেও অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এবারও পুরো মাস জুড়ে বিজয় কর্মসূচি পালন করা হবে। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। একই দিন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একটি প্রতিনিধিদল টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এবারের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্ণ হবে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের আজকের দিনে অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রিয় স্বাধীনতা। ওই দিন জাতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করবে সেসব শহীদকে, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। স্মরণ করবে সেই বীর সেনানীদের যারা একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যেসব নর-নারীর সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন, তাদের সবার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্মান জানানো হবে। জাতীয় কর্মসূচি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশ হবে। জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। হাসপাতাল, জেলখানা, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ সরকারি শিশুসদন, বিভিন্ন অনাথ আশ্রয়কেন্দ্র এবং এ জাতীয় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘর বিনা টিকিটে খোলা রাখা হবে। এবারের বিজয় দিবসের উদযাপনে নতুনত্ব হিসেবে থাকবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অঙ্গীকার। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত সৃষ্টির জন্য আলোচনা সভা করার বিষয়টি জাতীয় কর্মসূচিতে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিজয় দিবসের বিভিন্ন আলোচনায় এবার গুরুত্ব পাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচারণা। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদ দমনে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করেছে। সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে যাতে কেউ সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত কোনো কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতে না পারে এবং এ ধরনের কার্যকলাপে কোনো দেশ বা সংগঠন যাতে আর্থিক সহযোগিতা না করে সে ব্যাপারে সরকার সবসময়ই সচেতন। একই সঙ্গে জনগণেরও এ বিষয়ে আরো বেশি সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বিজয় দিবসের আয়োজনে, আলোচনা সভায় বিষয়গুলোর প্রতি প্রাধান্য দেওয়ার জন্য এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জানানো হয়েছে। জানা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং রাতে আলোকসজ্জা করা হবে। প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলোয় জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাদক দল বাদ্য বাজাবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। রেডিও-টেলিভিশনে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা সদর ও জেলার অন্যান্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কুচকাওয়াজ : সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁওয়ে পুরনো বিমানবন্দরস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এ সময় বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীও হবে। প্রধানমন্ত্রীও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কর্মসূচি আওয়ামী লীগ : মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে সকাল সাড়ে ১০টায় পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয় র‌্যালি করবে আওয়ামী লীগ। ঢাকা মহানগরীর অন্তর্গত সব থানা শাখা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকা থেকে বিজয় র‌্যালিসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হবেন। সেখানে স্থাপিত শিখা চিরন্তনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় মিছিল শুরু হবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৭ ডিসেম্বর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে। সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি থাকবেন। বিএনপি : বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস উদযাপনে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৪ ডিসেম্বর সকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। এছাড়া আলোচনা সভা করা হবে। মহান বিজয় দিবসে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। এদিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাভার স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এর পর তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাবেন। সেখানে তিনি ফাতেহা পাঠ, দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেবেন। বিজয় দিবসে বিএনপির উদ্যোগে একটি আলোচনা সভা ও র‌্যালি বের করা হবে। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ২৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ করা হবে। সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এছাড়া মহান বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে অন্যান্য রাজনৈতিক এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/রফিক