রাইজিংবিডি স্পেশাল

এখনো ভারতের মাটিতে শুয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা

হাসান মাহামুদ : মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সীমান্ত এলাকায় দাফন করা হয় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। পরবর্তীতে এসব এলাকায় বেশকিছু কবর শনাক্ত করা হয়। ভারতও এসব কবর তুলে আনার ব্যাপারে সহযোগিতার মনোভাব দেখায়। দু’দেশের নোডাল অফিসার নিয়োগ হয়। কিন্তু এরপরই অজানা কারণে থেমে যায় সব উদ্যোগ। ফলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েও অসংখ্য বীর এখনো শুয়ে আছেন ভারত ও দু’দেশের সীমান্ত এলাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কবর খোঁজার পেছনে একটি জাতীয় আবেগ কাজ করছে৷ এর পেছনে রয়েছে দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ চাওয়াও। অনেক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আকুতি ছিল, যদি এই মহান যুদ্ধে তারা শহিদ হন, তাহলে যেন তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাফন করা হয়৷ এর পেছনে দুটো বৃহৎ যুক্তি ছিল তাদের। প্রথমত, দেশের জন্য প্রাণ দিয়েও যেন শেষ আশ্রয় হয় স্বাধীন মাটিতে এবং দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা তখন সব ধরনের মানবিকতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহ দেখলেই, তা বিকৃত করে দিত৷ অসম্মান করত কবরস্থানের৷ এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ চাওয়া ছিল, দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে অন্তত সম্মানের সঙ্গে কবরে যেতে পারা। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তিম এই চাওয়াটা আমরা এখনো পূরণ করতে পারিনি। এমনকি ভারত কিংবা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় কতজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে, সেটাই এখনো নির্ণয় করতে পারিনি ৪৬ বছরে। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবর স্থানান্তর দিয়ে শুরু : বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ববোধ থেকে ভারতে সমাহিত মুক্তিযোদ্ধাদের আনার বিষয়টি অনেক আগেই পরিকল্পনায় আনা হয়। ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর অনুসন্ধানের কাজে প্রথম সাফল্য আসে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে৷ ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ৮৪ কিলোমিটার দূরে ধলাই জেলার সদর দপ্তর আম্বাসার ১০ কিলোমিটার দূরত্বে হাতিমারাছড়ায় উদ্ধার করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ৷ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় কবর থেকে তার দেহাবশেষ উদ্ধার করে আনা হয় ঢাকায়৷ পরে তা দাফন করা হয় মিরপুরে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থানে৷ প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে জানানো হয়, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়– এই চারটি রাজ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়েছিল। এরপর ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের শহিদদের কবর খুঁজে বের করার পন্থা-পদ্ধতি নিয়ে ত্রিপুরায় ভারতীয় ও বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়৷ উভয় দেশের কর্মকর্তারা এ কাজে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের পক্ষ থেকে আগরতলা, কলকাতা, গুয়াহাটি এবং শিলংয়ে চারজন নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশ কবর খোঁজা ও তালিকা তৈরির কাজ করবে। ভারতীয় নোডাল অফিসাররা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে সাহায্য করবেন৷ অজানা কারণে আটকে আছে মহতী উদ্যোগ : ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন ২৭টি স্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়৷ এসব স্থানে সাড়ে তিন হাজার শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কবর শনাক্ত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সরকার এসব মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। নতুন করে আবার আলোচনা শুরু হয় ভারতের সঙ্গে। তখন পশ্চিম ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রদেয় সম্ভাব্য স্থানগুলোর তালিকার ভিত্তিতে স্থানীয় লোকজনদের সাহায্যে তা খুঁজে দেখা হবে৷ বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কবর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে৷ একটি রামনগরে এবং অপরটি গোলচক্করে৷ বাংলাদেশ চাইলে শহিদদের দেহাবশেষ স্বদেশে নিয়ে যেতে পারবে প্রোটোকল মেনে, তা না হলে বর্তমান স্থানেই কবরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে৷’ কিন্তু এরপর অজানা কারণে আটকে আছে এই উদ্যোগ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা৷ এর মধ্যে ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার৷ এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার এক বিশেষ স্থান আছে৷ ত্রিপুরা ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়া মানুষদের জন্য অলিখিত সদর দপ্তর৷ তখন ১৬ লাখ বাংলাদেশি আশ্রয় দিয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই ছোট রাজ্যটি, যার নিজস্ব লোকসংখ্যা ১৫ লাখের মতো৷ বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামে৷ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি আছেন নিখোঁজের তালিকায়৷ আশঙ্কা করা হচ্ছে এসব মুক্তিযোদ্ধার সিংহভাগকেই ভারতের মাটিতে কবর দেওয়া হয়েছে। ‍ এর আগে ২০১২ সালে নবম সংসদ অধিবেশনে এইচ এন আশিকুর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ভারতে সমাহিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি চিহ্নিত করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ভারতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমাধি চিহ্নিত করতে পেরেছে। পর্যায়ক্রমে এসব মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের সহায়তায় এসব মুক্তিযোদ্ধার হাড়গোড় পরীক্ষা করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা সম্মান জানাতে পারে। মন্ত্রী তখন আরো বলেছিলেন, সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাতে তিন একর জমি অধিগ্রহণ করেছে একটি জাতীয় সমাধিক্ষেত্র তৈরির জন্য। তার অদূরে ভারতে ২৫১ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ তুলে এনে কসবাতে সমাহিত করা হবে। কিন্তু এরপর আর এ বিষয়টির কোনো অগ্রগতি পাওয়া যায়নি। এমনকি গত কয়েক বছরে ত্রিপুরার অসংখ্য কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে এসেছে। অনেক বাঙালিও গিয়েছেন। কিন্তু এসব শনাক্ত হওয়া মুক্তিযোদ্ধার কবর স্থানান্তরে কোনো উদ্যোগই পরবর্তীতে আর গ্রহণ করা হয়নি। অবহেলায় ত্রিপুরার দক্ষিণ রামনগরে চিহ্নিত ৭০ মুক্তিযোদ্ধার কবর : সম্প্রতি জানা যায়, বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার দক্ষিণ রামনগরের মাটিতে শুয়ে আছেন প্রায় ৭০ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত ও যুদ্ধে আহত ত্রিপুরার আগরতলা জিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া এসব মুক্তিযোদ্ধাকে এই দক্ষিণ রামনগরে কবর দেওয়া হয়েছে। আখাউড়ার সেনারবাদী বরাবর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার দক্ষিণ রামনগর। সেনারবাদী থেকে রামনগরের শূন্যরেখায় ওই কবরগুলো দেখা যায়। তবে গাছগাছালি আর লতাপাতা কবরগুলোকে ঘিরে রেখেছে। এখানকার মূল সমস্যা হচ্ছে, কবরগুলো ভারত-বাংলাদেশের শূন্য রেখার পাশে ভারতের ভেতরে হওয়ায় পরিচর্যা করা যাচ্ছে না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বাইরে ও ভেতরে রয়েছে কবরগুলো। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশের একজন জেলা কালেক্টর জানান, কবরস্থানের পূর্বে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। এরপর খাল। পশ্চিমে খাল, তারপর বাংলাদেশ সীমানা। দক্ষিণে জঙ্গল ও উত্তরে খাল। কবরের তিন দিকের খালেই কচুরিপানা। দেখলেই বোঝা যায়, দীর্ঘদিনেও ওই কবরস্থানে কারও হাত পড়েনি। ৪৬ বছরেও কেউ খবর রাখেনি এই শহিদদের কবরস্থানের। জানতে চাইলে আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক জানান, তার বাড়ির পাশেই ওপারে প্রায় ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার গণকবর রয়েছে। এত কাছে থেকেও সহকর্মীদের কবরগুলোর জন্য কিছুই করতে পারছি না। তিনি আরও জানান, একাত্তরে আগরতলার দক্ষিণ রামনগরে একটি ইটভাটা ছিল। ওই ইটভাটার পশ্চিমে বাংলাদেশের যেসব মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আঘাত পেয়ে আগরতলা জিবি হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় মারা গেছে, তাদেরকে ওই স্থানেই কবর দেওয়া হয়েছে। তিনি কবরগুলোকে পরিচর্যা করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণেরও দাবি জানান। নিভৃতে একা কাজ করছেন এক মুক্তিযোদ্ধা : কারো সহায়তা ছাড়াই একাই এক মহান অভিযানে নামেন অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সাজ্জাত আলি জাহির বীরপ্রতীক৷ ছয় বছর আগে শুরু হয় তার এই এককযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধে যেসব শহিদকে ভারতের মাটিতে কবরস্থ করা হয়, সেসব কবরের সন্ধান করে চলেছেন তিনি নিভৃতে। এ কাজ করতে গিয়ে লে. কর্নেল সাজ্জাত আলি জাহির বীরপ্রতীক দেখা করেন ভারতের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে৷ কর্নেল সাজ্জাদের দেওয়া রিপোর্টের সত্যতা রাজ্য সরকার বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সরকারের রিপোর্টের সঙ্গে যাচাই করার পর ভারত তা মেনে নেয়৷ এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সাজ্জাদ আলি জাহির বীরপ্রতীকের মতামত হচ্ছে, ‘যুদ্ধক্ষেত্রের আশপাশে পাকিস্তানি সেনারা যখনই কোনো মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ পেত, সেগুলো বিকৃত করত৷ কবরগুলোর অসম্মান করত৷ তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নো-ম্যানস ল্যান্ডে বা ভারতের কবরস্থানে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরের আশপাশে কবরস্থ করতাম৷ যদিও তরুণ-কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আকুতি ছিল, তাদের মরদেহ যেন বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়৷ আমাদের কাজ কিংবা দায়িত্ব এখনো শেষ হয়নি। সেই কাজটি করার চেষ্টা করছি মাত্র।’ তিনি বলেন, ‘আজ অনেকের মধ্যে সেই উদ্দীপনা দেখছি৷ অনেক সহযোগিতা পাচ্ছি৷’ লে. কর্নেল সাজ্জাদের অবিচল নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম দেখে তাতে শামিল হয় বর্তমান সরকার। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ভারতও৷ সাজ্জাদ আলি জাহিরের তৎপরতায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে দু’দেশের কূটনৈতিক প্রোটোকলে মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ সম্মানের সঙ্গে স্থানান্তরিত করার ইস্যুটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ প্রসঙ্গত, সমর কৌশলের বিচারে একাত্তরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় দুরবিন টিলার যুদ্ধ ছিল এক অসম লড়াই- পাকিস্তানি বাহিনীর দেড়শ সৈনিকের বিপরীতে মাত্র আটজন বাঙালির মরিয়া চেষ্টা। সেই যুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় পরে সিলেট অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে বড় ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধে দুরবিন টিলার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে স্বাধীনতার পর তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসরে যান। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/মুশফিক