রাইজিংবিডি স্পেশাল

বিদেশি চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আসছে বিকৃতরূপে

হাসান মাহামুদ : একাত্তরে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অজস্র ত্যাগ-তিতিক্ষার ফল আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটিয়ে তুলতে এবং প্রতিষ্ঠিত করতে কর্মকাণ্ড হয়নি বেশি। ফলে এখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভ্রান্তমূলক তথ্য উপস্থাপন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে উল্লেখ করতে দেখা গেছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে। আবার ভারতের কয়েকটি চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের মানুষের একটি গণযুদ্ধ হিসেবে না দেখিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতের বিজয়গাঁথা হিসেবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রকাশনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রাদেশিক যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে কূটনীতি দুর্বল। এ কারণে হলিউডের বিশাল ক্যানভাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুয়ান্ডা গণহত্যা নিয়ে সিনেমা নির্মিত হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেখানে ঠাঁই পায়নি। বলিউড ও টালিউডে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এলেও সেখানে রয়েছে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ। বিশেষ করে বিশ্ব চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট একেবারেই ধরা পড়েনি। হলিউডের মতো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এমনকি যেসব চলচ্চিত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত হয়েছে, তাতে বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজন্য বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উদ্যোগী হয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রয়োজন। এমনকি বিভিন্ন দেশের সেন্সর বোর্ডের কাছে ‘উপস্থাপিত বিভ্রান্তকর তথ্য’ পরিহারের জন্যও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত ভিনদেশের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মিত্রপক্ষ ও প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। কিন্তু এসব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র বেশ সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ মধ্যে পাকিস্তানে দোস্তি, তেহজিব, বিয়ন্ড দ্য লাস্ট মাউন্টেন নামে কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এসব চলচ্চিত্রের মুখ্য বিষয় ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর কূটনীতি। কিন্তু এসবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্থান পায়নি। ভারতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ নব্বই দশক পর্যন্ত হতে দেখা যায়নি। এরপর গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় দেশটিতে। এর মধ্যে ২০০২ সালে মুক্তি পায় মানি শংকরের ‘ডিসেম্বর সিক্সটিন’, ২০১২ সালে সালমান রুশদির উপন্যাস থেকে নির্মিত হয় ‘মিড নাইট চিলড্রেন’। ২০১৪ সালে আলী আব্বাস জাফরের ‘গুন্ডে’, একই বছর মৃত্যুঞ্জয় রায়ের ‘চিলড্রেন অব ওয়ার’ এবং চলতি বছর মুক্তি পায় সংকল্প রেড্ডির ‘দ্য গাজী অ্যাটাক’। এসব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখা হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। এসব চলচ্চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব চলচ্চিত্রে একাত্তরকে একটি স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবে না দেখিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকটি পার্টিশন হিসেবে। কিছু ছবিতে দেখানো হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে। ছবিগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান ছিল উপেক্ষিত। অধিকাংশ ছবি দেখে মনে হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ধর্ষিত হওয়া ছাড়া বোধ হয় আর কোনো অবদান নেই। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণকে অস্বীকার করে এটাকে কেবল সামরিক যুদ্ধ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের মানুষের একটি গণযুদ্ধ হিসেবে না দেখিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতের বিজয়গাঁথা হিসেবে। এমনকি কিছু চলচ্চিত্রে ‘ইন্দো-পাক যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশের জন্ম’ এমন একটি প্রপাগন্ডা প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একাত্তর ছিল শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ‘গুন্ডে’ সিনেমায় দেখানো হয়েছে ভারতের জয়জয়কার : ছবিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যে বাংলাদেশের আপামর গণমানুষের যুদ্ধ ছিল সেই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কৌশলে। চলচ্চিত্রটির কাহিনিতে দেখানো হয়, ১৯৭১ সালে হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর এর ফলেই জন্ম হয় বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের। এ ছাড়া সিনেমাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷ শুরুতে ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খানের কণ্ঠে হিন্দিতে বলা হয় ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, শেষ হলো ভারত পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ৷ সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে৷ এই যুদ্ধের ফলে জন্ম নিল নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ৷’ এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে তখন জোরালো প্রতিবাদ হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত তথ্য দেওয়ার অভিযোগে সিনেমাটি সংশোধনের দাবি জানান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও সুশীল সমাজ৷ এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা না থাকায়, বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি। ‘চিলড্রেন অব ওয়ার’ সিনেমায় বিকৃতভাবে ‘ধর্ষণ’ উপস্থাপন : ‘চিলড্রেন অব ওয়ার : নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ ছবিটি নির্মিত হয় মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ওপর নির্যাতনের নির্মম চিত্র নিয়ে। কিন্তু সিনেমাটিতে ধর্ষণকে দেখানো হয়েছে এক ধরনের গ্ল্যামার সিম্বল হিসেবে। যুদ্ধকালীন সংকটকে তুলে ধরার পরিবর্তে নারী নির্যাতনকে দেখানো হয়েছে যৌনতার সুড়সুড়ি হিসেবে। সিনেমাটির প্রথম নাম ছিল ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’। যুদ্ধের সময় পাক হানাদার আর তার দোসরদের যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল প্রায় ২ লাখ নারীকে। ফলে যুদ্ধ শেষে জন্ম নেয় অসংখ্য যুদ্ধ শিশু। এই বিষয়টিকে উপজীব্য করা হয়েছিল সিনেসাটিতে। পরে নাম পরিবর্তন করা হলেও কাহিনি এবং ফোকাস সাবজেক্ট ঠিক রেখেছিল নির্মাতা। আর ওভাবেই মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। ভারতের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ দেখানো হয়েছে ‘ডিসেম্বর সিক্সটিন’ সিনেমায় : সিনেমাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি আসেনি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর তারিখটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে। ছবিটির ভাষ্য অনুসারে পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করার ফলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। চলচ্চিত্র পরিচালক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এসব বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা স্বীকার করি৷ তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি মেনে নেওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু চলচ্চিত্রের কথা যেগুলো বলছেন, এর বাইরেও বাইরের দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র বা ডকুমেন্টরিতেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়ে আসছে। এসব বন্ধ করা শুধু সমাধান নয়। আমাদেরও উদ্যোগী হতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে হবে। না হলে বিভ্রান্তির অবসান জটিল প্রক্রিয়া। এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতারও প্রয়োজন রয়েছে।’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নও প্রক্রিয়াধীন। তবে বিশাল পরিসরে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকেও এগিয়ে আসতে হবে আমাদের। এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে সরকার আগ্রহী।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/সাইফুল