রাইজিংবিডি স্পেশাল

সমুদ্রগামী বড় জাহাজ আমদানিতে ফের ভ্যাট অব্যাহতি

এম এ রহমান মাসুম : সমুদ্রগামী বড় জাহাজ আমদানিতে আবারো ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন সূত্র রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন। বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং বিরাট অংকের ফ্রেইট চার্জের অর্থ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতেই বিশেষ এ প্রণোদনা দিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ‌্যে এনবিআর থেকে পাঠানো প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ২ মার্চ মন্ত্রণালয়ে এনবিআরের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। খুব শিগগিরই এনবিআর থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন সূত্র রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছেন। এর আগে ১৯৯৪ সালের ৯ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিন হাজার টনের বেশি (ডেডওয়েট টনেজ বা ডিডব্লিউটি) ধারণক্ষমতার জাহাজ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয় এনবিআর। ২০১২ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা চালু ছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার পর জাহাজ আমদানি বা উৎপাদন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর যুক্ত হয়। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন করে কেউ আর এ ব্যবসায় নামেননি। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আমদানি-রপ্তানির বিপরীতে ফ্রেইট চার্জ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৭০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ধরতে পেরেছে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজগুলো। বাকি ৫৫ হাজার কোটি টাকা বা ৮৫ শতাংশই নিয়ে গেছে বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজগুলো। নীতি সহায়তার অভাবে সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আমদানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহারের পর নতুন জাহাজ আমদানি করেননি স্থানীয়রা। পাশাপাশি করপোরেট করসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পুরনো জাহাজ প্রতিস্থাপন করেননি তারা। ফলে কমে গেছে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা। সেই সঙ্গে ফ্রেইট চার্জ বাবদ আয়ও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি অনুযায়ী দেশের বার্ষিক আমদানির ৫০ শতাংশ স্থানীয় জাহাজের মাধ্যমে সম্পন্নের কথা থাকলেও দেশে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ (ওশান গোয়িং কার্গো) কমে যাওয়ায় তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। রপ্তানি পণ্যের অর্ধেকের বেশি এক সময় স্থানীয় জাহাজগুলো পরিবহন করলেও, কমেছে তাও। মূলত বৈশ্বিক বাণিজ্য মন্দা, জাহাজ আমদানিতে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ৫ শতাংশ এটিভি ও ৩৫ শতাংশ হারে করপোরেট করের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগের পরও রিটার্ন না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন বন্ধ করে জাহাজ ব্যবসা থেকে সরে আসছেন। এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া এনডিসি বলেন, ‘এনবিআরের অবস্থান হলো করবান্ধব ও বিনিয়োগবান্ধব। বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ কমে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে মূলত বাল্ক/কনটেইনারবাহী জাহাজ আমদানি করা হয়। অন্যদিকে দেশীয় উদ্যোক্তারাও জাহাজ নির্মাণ করছেন। সব দিক বিবেচনা করে ভ্যাট অব্যাহতির বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’ বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশী পতাকাবাহী মোট ৬৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ চালু ছিল। এর মধ্যে বেসরকারি জাহাজ ছিল ৫২টি ও সরকারি ১১টি। ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনকারী বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ দাঁড়ায় ৩৮টিতে। এর মধ্যে সরকারি জাহাজ তিনটি ও বেসরকারি ৩৫টি। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে জাহাজের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশী পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। ২০১৪ সালেও প্রতিষ্ঠানটির অধীনে সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল ১৭টি। এখন তা নেমে এসেছে তিনটিতে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এইচআরসি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ১০টি সমুদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহনে থাকলেও এখন পুরোপুরি বন্ধ। বৈশ্বিক বাণিজ্যে মন্দা ও নীতি সহায়তার অভাবে অন্য দেশের জাহাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠায় এ ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ মার্চ ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ