রাইজিংবিডি স্পেশাল

ঘুষসহ ধরিয়ে দিয়ে বিপাকে অভিযোগকারী

এম এ রহমান মাসুম : ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হককে গ্রেপ্তারে সাহায্য করে বিপাকে পড়েছে অভিযোগকারী সৈয়দ শিপিং লাইনস নামের একটি শিপিং প্রতিষ্ঠান। এস এম নাজমুল হকের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ জীবননাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করে এরই মধ্যে সৈয়দ শিপিং লাইনসের মালিক সৈয়দ জালাল উদ্দিনের ছেলে সৈয়দ সোহাগ গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ২২৩) করেছেন। জিডিতে বিভিন্ন মোবাইল ফোন নম্বর থেকে নাজমুল হকের হুমকির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে উল্রেখ করেছেন। জানতে চাইলে সৈয়দ সোহাগ বলেন, ‘নাজমুল হক তাকে চাপে রাখার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছেন। জাহাজের কাগজপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুতে খুঁত বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। তবে, জিডি করা এবং দুদকে অভিযোগ করার পর আপাতত হুমকি-ধমকি বন্ধ হয়েছে।’ কিন্তু আশঙ্কা কমেনি বলে জানান তিনি। এ ছাড়া সৈয়দ সোহাগ গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুদকের চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার, মহাপরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছেন। চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি দুদক চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দপ্তর রাইজিংবিডির কাছে স্বীকার করেছে। সেখানে অভিযোগকারী সৈয়দ সোহাগ বলেছেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এর সহকারী পরিচালক ওয়াদুদ বরাবর একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলাম। যেখানে ঘুষ গ্রহণকালে দুদক কর্তৃক হাতেনাতে আটককৃত এস এম নাজমুল হক সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। উক্ত অভিযোগপত্র দেওয়ার পর থেকে আসামি নাজমুল হক লোক মারফত ও নিজে বিভিন্ন নম্বর ব্যবহার করে হুমকি দিয়ে আসছেন। এছাড়া আমাকে জোড় করে তার ইচ্ছামত লিখিত ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। তার এ ধরণের কার্যকলাপে আমার বাবা সম্পূর্ণ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমার ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। আসামী নাজমুল হকের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ভয়ে আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যে কোনো সময় আমার অসুস্থ বাবার বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টিকে অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে বড় ধরণের বিপদ ঘটার পূর্বেই আমাদের জীবন রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করছি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি অভিযোগটি পেয়েছে এবং পড়েছি। এ বিষয়ে আমি মহাপরিচালককে (প্রশাসন)  আইনগত কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। ইতিমধ্যে নাজমুল হকের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে।’ অভিযোগকারীর নিরাপত্তায় দুদকের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবে পুলিশ। অভিযোগকারী থানায় জিডি করেছেন। আমরা পুলিশকে লিখবো জিডি অনুসারে তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে।’  চলতি বছরের ১২ এপ্রিল ফাঁদ পেতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি হোটেল থেকে ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয় এস এম নাজমুল হককে। ওই দিনই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় রাজধানীর শাহবাগ থানায়। এর ৫ মাস পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর জামিনে বেরিয়ে আসেন নাজমুল হক। দুদক সূত্র জানায়, মেসার্স সৈয়দ শিপিং লাইনসের এমভি প্রিন্স অব সোহাগ নামীয় যাত্রীবাহী নৌযানের রিসিভ নকশা অনুমোদন এবং নতুন নৌযানের নামকরণের অনাপত্তিপত্রের জন্য নাজমুল হকের কাছে গেলে তিনি ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিষয়টি দুদককে অবহিত করেন। এরপর কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ারে নেতৃত্বে বিকেল পৌনে ৬টায় ঘুষের টাকার কিস্তি বাবদ ৫ লাখ টাকাসহ রাজধানীর সেগুন বাগিচায় সেগুন হোটেলে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেন দুদকের বিশেষ দলের সদস্যরা। অভিযানে অংশ নেওয়া দুদকের বিশেষ দলের টিমের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ, জাহাঙ্গীর আলম, রেজাউল করিম, মো. মাসুদুর রহমান, আবদুল বারী এবং উপ-সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান ও নাজমুস সাদাত। বর্তমানে চার্জশিট আদালতে দাখিল করার প্রক্রিয়া চলছে।’ প্রায় একই প্রক্রিয়ায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মন্ত্রণালয় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। ২০ আগস্ট এস এম নাজমুল হক প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব পান। ২০১৪ সাল থেকে সমুদ্র অধিদপ্তরের শিপ সার্ভেয়ার ও পরীক্ষক থাকার সময় এ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান শুরুর দুই বছর পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকে সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) মোহাম্মদ ইব্রাহিম নাজমুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। কমিশন সভায় ওই সুপারিশ নাকচ করে আবারও অনুসন্ধানের জন্য উপপরিচালক হামিদুল হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। হামিদুল হাসানও অজ্ঞাত কারণে তাঁকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন। গত বছরের মাঝামাঝি নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় উপপরিচালক বেনজির আহমেদকে। তিনি নাজমুলের সম্পদ বিবরণী তলব করলে নাজমুল একটি বিবরণী জমা দেন। এর মধ্যেই হঠাৎ করে ঢাকার বাইরে বদলি হন বেনজীর আহমেদ। এরপর সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ নাজমুলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছেন।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ