রাইজিংবিডি স্পেশাল

বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুদকের নতুন উদ্যোগ

এম এ রহমান মাসুম : রাষ্ট্রের বড়-ছোট দুর্নীতিবাজদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে নতুন পথে হাঁটছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বড় ধরনের দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে চাচ্ছে সংস্থাটি। বিভিন্ন সময় দুদকের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও অভিযোগের কড়া জবাব দিতে চায় কাজের মাধ্যমে। একই সঙ্গে নতুন সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রকৃত বাস্তবায়ন করতে চায় সংস্থাটি। এরই মধ্যে লক্ষ্য পূরণে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে কমিশন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের তালিকা সংগ্রহ, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের নির্বাচনী হলফনামা সংগ্রহ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধ তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, মন্ত্রণালয় ও সেক্টর ভিত্তিক দুর্নীতির ফিরিস্তি জোগাড় ও করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও কমিশনারসহ দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আগামি এক-দুই মাসের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি বিষয়ে ঘোষণা ইতিমধ্যে দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আমরা আগের থেকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী; কারণ, বর্তমান সরকারের ম্যান্ডেট ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। আমরা প্রত্যাশা করি সরকার আমাদেরকে সকল প্রকার সহযোগিতা করবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের জন্য যা যা করা দরকার আমরা করব। নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, স্বাস্থ্য-শিক্ষা বাণিজ্যসহ সমস্ত জায়গায় যেসব দুর্নীতি-অনিয়ম রয়েছে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করব এবং তবে দমনেরও চেষ্টা করব আমরা। কোনো বাধাই মানব না।’ ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি যেখানে আছে, দুর্নীতির গন্ধ যেখানে আছে আমরা সেখানে থাকব। প্রাক্তন মন্ত্রী বা বর্তমান বলে কথা নেই, আমরা সবাইকে একই পাল্লায় মাপতে চাই। অভিযোগ যদি থেকে থাকে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করব। কথা এইটুকুই বলতে পারি যে, আপনারা এক মাস দুই মাসের মধ্যে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাবেন। তবে কতগুলো বিষয়ে আমাদের প্রধান ফোকাস থাকবে। আর্থিক দুর্নীতি- এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা আমাদের পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে আর্থিক দুর্নীতি বন্ধ করার চেষ্টা করব।’ এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দুদক এবার সরকারি বা বিরোধী দল হিসেব না করে দুর্নীতিবাজ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব‌্যবস্থা নেবে। ইতিমধ‌্যে হলফনামা যাচাই-বাছাই করে কয়েকজন প্রভাবশালীর ব‌্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুদক চেয়ারম‌্যান ইতিমধ‌্যে যেসব ইঙ্গিত দিয়েছেন তার দৃশ‌্যমান বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এবার আর সরকারি দল সংশ্লিষ্টদের মুক্তি মিলবে না।’ অন্যদিকে দুদক কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘শুধু চুনোপুটির বিরুদ্ধে ব‌্যবস্থা নিলে তো হবে না। এবারে আমাদের রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। যেখানে সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সেখানে আমাদের কাজ অনেক বেড়ে যায়। মানুষ এখন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আমরা যদি এখন এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারি তাহলে তা হবে আমাদের ব্যর্থতা। শিগগিরই পুরো কমিশন কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা কাউকে আর ছাড় দিতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। আগের চেয়ে তাদের গুণগত মানের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। নিম্নস্তর থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছি। এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কোনো হতাশা নেই। তারাও কাজ করতে চায়। আমাদের অফিসিয়াল কাজের পরিধি ও লোকবল আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন কাজের মাধ্যমে আমাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা প্রমাণের সুযোগ এসেছে।’ এ বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে এখন পর্যন্ত দুদকে বিভিন্ন প্রার্থীর বিরুদ্ধে কয়েক হাজার অভিযোগ এসেছে। দুদক কৌশলগত কারণে ওই অভিযোগ নিয়ে কাজ করেনি। তবে অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে এর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। অর্থ্যাৎ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করা। এক্ষেত্রে অনেক কাজই এগিয়ে আনা হয়েছে। বেশ কয়েকটি তালিকা প্রস্তুত রয়েছে। এবার তালিকা অনুসারে বাস্তবায়নের পালা। সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে আর্থিক দুর্নীতি। বিগত সময়ে এই খাতের ভয়াবহ দুর্নাম রয়েছে। সরকারও চাচ্ছে এই খাতে শুদ্ধি অভিযান চালানো। এরপরই রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ‌্য। এভাবে পর্যায়ক্রমে সকল সেক্টরের দুর্নীতি নিয়ে দুদক দৃশ‌্যমান কাজ করবে।’ অন‌্যদিকে ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ছিল। যার অন্যতম প্রধান ঘোষণা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ। যেখানে বলা হয়, দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি আরো জোরদার করবে।’ এমনকি নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রায় প্রত‌্যেক সদস‌্য তাদের প্রথম কর্মদিবসে দুর্নীতি নির্মূলের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বক্তব‌্য রেখেছেন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জানুয়ারি ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ