রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘পাজারো’তে জীবন পার!

আরিফ সাওন : অনেক আগের কথা! খুব ছোট্ট বেলায় ঢাকায় এসেছেন; আবছা আবছা মনে আছে! এখন বয়স ৫০ এর কাছাকাছি কিংবা বা বেশি- তাও ঠিক করে বলতে পারেন না। তবে জীবনের প্রায় এতটি বছরই ‘পাজারো’তে পার করেছেন মনি বেগম।

শুধু মনি বেগম নয়, তার মতো আরো অনেকেই ‘পাজারো’তে জীবন পার করছেন। এ ‘পাজারো’ বিলাসবহুল দামি গাড়ি নয়! চার চাকার ছোট্ট একটা কাঠের গাড়ি। আকার আর আয়তন খুবই  ছোট্ট। শারীরিকভাবে অক্ষম কিছু লোককে তাদের স্বজনরা এই গাড়িতে রেখে জীবন কাটান। এটাই কারো রাজপ্রাসাদ! এটাই কারো বাড়িঘর। এটাই কারো সোনার সংসার।

‘পাজারো’ আকারে এত ছোট যে শুয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা নেই।  হেলান দিয়ে বসে ঘুমাতে হয়। নেই বালিশও। যেখানে একজনের শোয়ারই জায়গা নেই, সেখানে এত ছোট আকারের ‘পাজারো’তে দুইজনও ঘুমান।

ঢাকার হাইকোর্ট মাজারের গেটে গেলে এমন অনেক ‘পাজারো’ দেখতে পাওয়া যায়। ‘পাজারো’র চাকাগুলো বেয়ারিংয়ের। নেই কোনো ইঞ্জিন। প্রতিটি ‘পাজারো’তে আছে পলিথিন (বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য)। কোনোটা  কালো রংয়ের। কোনোটা আবার নীল।

   

মাজার গেটের বাইরে বসে কেউ ঘুমাচ্ছেন। কেউ গল্প করছেন। কেউ বসে আছেন। আবার কেউ কেউ রয়েছেন কোনো কিছু পাওয়ার অপেক্ষায়! তবে বড় কিছু বা বেশি কিছু চাওয়ার পাওয়া নেই তাদের! তারা চান খাবারের জন্য কিছু টাকা পেলেই হলো।  যদি কেউ দেয় তো খাবেন, না দিলে কারো কারো হয়তো সেই বেলা না খেয়েই কাটবে! আবার কখনো কখনো কেউ কেউ খুব ছোট পাত্রে সামান্য কিছু সেদ্ধ করে খান। তাদের ধারণা মাজারই তাদের খাওয়ায়।

কেউ ৪০ বছর, কেউ ৫০ বছর, আবার কেউ কত বছর ধরে আছেন তা জানেনও না। তবে মনি বেগমের মনে আছে। তিনি ৮ থেকে ৯ বছর বয়সে এখানে এসেছেন। সে হিসেবে অন্তত ৪০ বছর ‘পাজারো’তে।

এখন তার (মনি) চেহারায় বয়সের ছাপ। চোখের নিচে কালো ছোপ। ত্বক তামাটে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ। চেহারায়ই ফুটে উঠেছে অন্তরে জমে থাকা কষ্ট। তবে এই কষ্ট সহজেই প্রকাশ করতে চান না মনি বেগম।

কথা হয় (১৭ জুন) সিরাজ উদ্দিনের সঙ্গে। শরীরটা ভালো নেই তার। পায়ে ব্যাথা। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। তাই কোথাও কোনো কাজে যাওয়া হয়নি। তিনি দিনমজুর। রাজধানীতে যে কাজ পান, সেই কাজই করেন।

শরীর ভালো না থাকায় স্ত্রী মনি বেগমের গাড়িতে বিশ্রাস নিচ্ছেন সিরাজ। পাশে স্ত্রীও (মনি) আছেন। মাঝে মাঝে সিরাজ পা-টা একটু টেনে দিতে বলছেন, কখনো কখনো বলছেন একটু চেপে দিতে, একটু ম্যাসেজ করতে। সিরাজ যা-ই বলছেন, মনি বেগম তাই-ই করছেন।

   

মনির অনেক স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু কি আর করার! সব কপাল বলেই মেনে নিয়েছেন! তবু মনের কষ্ট মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে আসে, মুখে ফুটে ওঠে। একবার স্বপ্নপূরণ না হলে কি হবে! আরো একবার স্বপ্ন দেখছেন মনি। পূরণ হোক আর না হোক স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

সিরাজ-মনি দম্পতির দুই মেয়ে। ইচ্ছা ছিলো সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন। বড় মেয়ে স্বপ্নাকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। দুই বছর হলো আর লেখাপড়া করছেন না। ভোলার আলতাজুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর মেয়েটি এক ছেলের সঙ্গে চলে যায়। তাকে নিয়ে গাজিপুরে গুচ্ছগ্রামে থাকে।

মনি বেগম বলেন, ‘ভোলায় এক বাড়িতে রেখে মেয়েকে পড়িয়েছি। নিজেরা রাস্তায় ঘুমিয়ে, খেয়ে না খেয়ে, মেয়ের জন্য টাকা পাঠিয়েছি। আর সেই মেয়ে আমাদের কথা ভাবল না।’

ভোলায় রাখার কারণ জানতে চাইলে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। মেঘনার ভাঙ্গণে বাড়ি ঘর হারিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। মাজারের এখানে এসে সিরাজের সাথে দেখা। ভালো লাগা। তারপর বিয়ে। সংসার শুরু।

   

বড় মেয়ে গেছে তাতে কি, এখন ছোট মেয়ে জেসমিন আছে। তাকেই নিয়ে আবার স্বপ্ন দেখছেন তারা। জেসমিন মোহাম্মদপুরে একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

‘পাজারো’তে সিরাজ ঘুমান না। তিনি ঘুমান ফুটপাতে। আর স্ত্রী ‘পাজারো’তে। কতদিন ধরে ‘পাজারো’তে ঘুমান জানতে চাইলে মনি বেগম একটু হেসে বলেন, ‘পাজারো’তেই জীবন পার করে দিলাম। অনেক আগে এটা বনিয়েছি। এখানে আসার পরপরই।

শাহনাজ। বাড়ি ফরিদপুরে। নদী ভাঙ্গণে নিঃস্ব হয়ে চলে এসেছেন ঢাকায়। এখানেই কথা হয় তার সাথে। বয়স যখন সাত কিংবা আট বছর, তখন ঢাকায় আসেন তিনি। সঙ্গে তার মা শাসসুন্নাহার। মা কথা বলতে পারেন না। তিনি প্রতিবন্ধী। জন্মের পর থেকেই মাকে এমন দেখছেন। বয়সের ভারে তার মা কুঁজো হয়ে গেছে।

শাহনাজ বলেন, ‘নদী ভাঙ্গণের পর তাদের আত্মীয়-স্বজনরা কেউ সাভার, কেউ গাজীপুর আর কেউ কামরাঙ্গীরচর থাকেন। আর এখানে থাকেন তারা মা মেয়ে।

তিনি জানান, শীতে কিংবা বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট হয়। শাহনাজের বিয়ে হয়েছিল প্রায় ১৫ বছর আগে। তার ভাষায়, স্বামী নেশার ভান করতেন। মারা গেছেন। স্বামীর বাড়ি ছিলো কুমিল্লা। এখানেই (মাজারেই) তাদের দেখা। তারপর বিয়ে। মেয়ের নাম সুমাইয়া। সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

   

শাহনাজের ‘পাজারো’তে দেখা যায়, লাল প্লাস্টিকের একটা থালা। দুইটা লাল গামলা। তাতেই তারা খাবার খান। পানি খাওয়ার জন্য গ্লাস নেই। আছে দুই লিটারের দুইটা প্লাটিকের বোতল। পানি আনেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বা মাজার থেকে। গাড়িতে ঝোলানো আছে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। আর রয়েছে কয়েকটি জামাকাপড়।

একটা পিঁড়িও আছে। জানান, গাড়ি বানানো সময় বসার জন্য পিঁড়িও বানিয়েছেন। আছে কালো পলিথিন। জানান, বৃষ্টি পড়লে ওই পলিথিনে গাড়ি মুড়িয়ে নেন।

শাহনাজ বলেন, ‘৬ হাজার টাকা দিয়ে পাজারো বানিয়েছি। দুই বছর পরপর বডি বানাতে হয়। গেলবার বডি বানাতে ২৫০০ টাকা লেগেছে। গড়ি বানানো একেবারে সহজ কাজ নয়। একটু ঝামেলা আছে। কাঠ আনতে হয় নয়াবাজার থেকে। চাকা বানাতে হয় ইংলিশ রোড থেকে। মিস্ত্রি আনন্দ বাজারে। চাকা আর কাঠ নিয়ে সেখান থেকে বানিয়ে আনতে হয়।’

বিলাশ বহুল পাজারো কিনতে লাখ লাখ টাকা লাগলেও এই পাজারোর বানাতে বেশি টাকা খচর হয় না। ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লাগে। তবে এটাই তাদের জন্য অনেক টাকার ব্যাপার! ফুটপাতে যার একটা পাজারো আছে সেই ফুটপাতের ধনী!

আরো পড়ুন :

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুন ২০১৯/সাওন/সাইফ