রাইজিংবিডি স্পেশাল

দ্রুত বিচার চলছে, শিগগিরই রায়ের প্রত্যাশা

মামুন খান : বাংলাদেশের মানুষ যা কল্পনা করতে পারেনি ঠিক তেমনই ভয়ংকর এক ঘটনার ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে।

পুরো বছরের প্রস্তুতির পর রমজান মাসে মানুষ যখন সিয়াম পালন ও ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত তেমনি এক সময়ে ইসলামের অপব্যাখাকারী একটি গোষ্ঠী কয়েকজন বিদেশী নাগরিকসহ ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুরো জাতি স্বম্ভিত হয়ে পড়ে।

ঢাকায় গ্রিন জোন হিসেবে পরিচিত এলাকায়  জঙ্গি হামলার ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তটস্থ হয়ে পড়ে। এতে অন্যান্য এলাকায় থাকা বিদেশীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরে সতর্কতাও জারি করে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। পরিশেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটনার ইতি ঘটলেও এর জের এখনো রয়ে গেছে। সে সময় নিহত এবং আহতদের স্বজনের কান্না এখনো থামেনি। প্রতি বছর ১ জুলাই তারা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট প্রাঙ্গনে ফুল হাতে জড়ো হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এদিকে ওই দিনের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাস বিরোধ আইনে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করে। মামলাটি তদন্ত করে  আট জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এরপর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলায় ২১১ সাক্ষীর মধ্যে ৬০ জনের সাক্ষ্য নেয়া শেষ হয়েছে। ২ জুলাই মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে। সাক্ষ্য দিতে ১১ সাক্ষীকে সমন পাঠিয়েছেন আদালত। মামলাটির বিচারকাজ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে শিগগিরই রায়ের প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে গেছে। তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সকল নেতাই ধারাবাহিক অভিযানে নিহত হয়েছেন বা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এ পর্যায়ে সকলের সমর্থিত বা মনোনীত অবিভক্ত কোন নেতা নেই। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে তাদের বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। এ পর্যায়ে জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মাত্রা খুব বেশি না হলেও সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সবাই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকলে জঙ্গিরা কখনোই সফল হবেন না বলে জানান তিনি।

মামলা সম্পর্কে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার মামলাটি বিশ্বের সংঘটিত নিন্দিত ঘটনাবলির মধ্যে একটি। সেদিনের হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খানসহ দেশী-বিদেশী আরো ২০ জন মারা যান। সেদিনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা চেষ্টা করেছিল অগ্রগামী বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় সন্ত্রাসীদের সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়। সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় এনে সাজা দেওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।

প্রসিকিউটর জাহাঙ্গীর বলেন, মামলাটি আমাদের ট্রাইব্যুনালে আসার পর আমরা রাষ্ট্রপক্ষের অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি যেন মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হয়। মামলার চার্জগঠনের পর ২০ থেকে ২২ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে পলাতক দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়। পলাতক দুই আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ লিগ্যাল এইড থেকে অ্যাডভোকেট নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর গ্রেপ্তারকৃত ওই দুই আসামি নিজস্বভাবে আইনজীবী নিয়োগ করে।

এ মামলায় প্রত্যেক সাক্ষীকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেছেন। যেভাবে মামলাটির বিচারকাজ এগিয়ে চলছে তাতে আমরা আশা করছি দ্রুত সময়, ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে মামলাটির বিচারকাজ শেষ হয়ে যাবে। সারা বিশ্ব মামলাটির বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে সাক্ষীদের উপস্থাপন করা হয়েছে তা আসামিদের দোষী প্রমাণ করতে সাহায্য করবে। এছাড়া যে সাক্ষীদের সাক্ষ্য হয়েছে পরবর্তী সাক্ষীকে অভিযোগ প্রমাণে সাহায্য করবে। এ মামলার ছয়জন আসামি আদালতে বিভিন্ন সময়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা নিজেদের অংশগ্রহণ , সহযোগিতা ও অপরাধে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। যে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন , যখন তারা সাক্ষী দিবেন সেটা চলে আসবে আর তখন এর বৈধতা চলে আসবে। ময়না তদন্তকারী ডাক্তার, সুরত হাল , জবানবন্দি রেকর্ড করা সাক্ষীর সাক্ষ্য মামলা প্রমাণের জন্য অগ্রগতি হবে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, এ মামলার কোন সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলায় ৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এদের মধ্যে কেউই আসামিদের নাম বলেননি। আসামিদের কাছ থেকে কোনো কিছু উদ্ধার হয়েছে মর্মেও আদালতের নথিপত্রে নেই। এ ছাড়া মূল আসামিদের আমরা (চার্জশিটভুক্ত আসামিরা) সহায়তা করেছি, এমন কথাও কোনো সাক্ষী আদালতে বলেননি। এমতাবস্থায় আশা করছি, আসামিরা এ মামলা থেকে খালাস পাবেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রতিটা সাক্ষীর দিন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে হাজির থাকেন। সে বিষয়টি সাক্ষীরা নিজেরা স্বীকার করেছেন তার উপস্থিত থাকার বিষয়ে। উনার উপস্থিতির কারণে সাক্ষীরা অনেক সময় অন্যরকম ফিল করেন।

তিনি বলেন, মামলাটি পরিচালনা করার জন্য আমরা সহযোগিতা করছি যার কারণে আজ পর্যন্ত অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। মামলার কার্যক্রম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে চলতি বছরের মধ্যে রায় ঘোষণা করতে পারবেন বিচারক। শিগগির রায় হয়ে গেলে বিষয়টিকে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাব।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হামলা করে এবং দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। এ সময় অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন।

এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় তিন বাংলাদেশিসহ ২০ জন জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।

পরদিন সকালে যৌথ বাহিনী কমান্ডো অভিযান চালায়। এতে ছয় হামলাকারী নিহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৩ জিম্মিকে।

ওই ঘটনায় ২ পুলিশ কর্মকর্তা, জাপানি, ইতালি, বাংলাদেশি বংশোদ্ভতু আমেরিকানসহ ১৮ বিদেশি ও ২ বাংলাদেশি এবং ৬ জঙ্গিসহ ২৮ জন নিহত হন।

২০১৬ সালের ৪ জুলাই নিহত ৫ জঙ্গিসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের  করেন গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস।

গত বছর ২৩ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবিরের দেয়া  চার্জশিটে আটজনের নাম থাকলেও হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করা হয়। তবে ১৩ আসামি বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। আর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। মামলাটিতে গত বছর ৮ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। আর হাসনাত রেজা করিমের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য-প্রমান না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। গত বছর ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন একই আদালত।

মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য মোট ২৯ কার্যদিবস ধার্য করা হয়েছে। এর মধ্যে সাক্ষী অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে আট কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। ২১ কার্যদিবসে মোট ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে মামলার বাদীসহ ৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

আসামিরা হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। এরা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুলাই ২০১৯/মামুন খান/এনএ